টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশগত সুরক্ষা

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশগত সুরক্ষা

  • প্রকাশিত ১০ মে, ২০২১

১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরেই বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।  মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও, একই সাথে কমেছে দারিদ্র্যের হার। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এখন আমরা সেই তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে এসে পৌঁছেছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি ও ভৌত অবকাঠামো ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অগ্রগতি আজ ঈর্ষান্বিত। এমডিজি বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। তবে যে বিষয়টি এখন সজোরেই আলোচনা হচ্ছে তা হলো, টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

দেশের  উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য পরিবেশগত ভারসাম্যের বিনষ্ট হওয়া, আমাদের কেবল হতাশই করে। টেকসই উন্নয়ন বলতে ওই সকল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে বোঝায়, যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও নিশ্চিত হয়, একই সাথে প্রকৃতি এবং বাস্তুতন্ত্রেও (ইকোসিস্টেম) তা কোনো প্রকার বিরূপ প্রভাব ফেলে না। তবে বাংলাদেশে যেভাবে টেকসই উন্নয়নের জায়গা থেকে সরে এসে পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থা  নষ্ট করে যেভাবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে, তা আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতিকে ভয়ানক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পৃথিবীর ১৮০টি দেশের মধ্যে পরিবেশ রক্ষা সূচকে আমাদের অবস্থান ১৭৯তম! এনভায়রনমেন্টাল পারফমমেন্স ইনডেক্স (ইপিআই)-এর ২০১৮ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে  উঠে এসেছে এসব তথ্য। তা ছাড়া এ বছর আমাদের ঢাকা পৃথিবীর দ্বিতীয় দূষিত শহরের খেতাবও পেয়েছে। আর্থ ডে নেটওয়ার্কের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে  প্লাস্টিক দূষণে আমরা বিশ্বে দশম।

২০০২ সালে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও তা দস্তুরমতো  অনেকটা প্রকাশ্যেই ব্যবহার হচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকা শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের প্রায় ৮০ ভাগ ড্রেন পলিথিন ব্যাগ কর্তৃক জমাট বেঁধে আছে। এর ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরে সৃষ্টি হয় অসহনীয় জলাবদ্ধতা। আমরা আমাদের নদীগুলো ভরাট করে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করছি, নদীর নাব্য ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। ধলেশ্বরী এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে। বুড়িগঙ্গাকে তো অনেক আগেই দূষিত করে রেখেছি আমরা; অন্যান্য নদীর অবস্থাও তথৈবচ।

আট বছরে পরিবেশ সূচকে আমরা পিছিয়েছি ৪০ ধাপ (ইপিআই ইনডেক্স)। আমাদের কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, বনভূমি উজাড় করে আমরা শিল্পকারখানা স্থাপন করছি। বাংলাদেশ মৃত্তিকা উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে যেভাবে কৃষিজমি অ-কৃষি কাজে ব্যবহূত হচ্ছে তাতে করে ২০৭০ সাল নাগাদ দেশে কোনো কৃষিজমি থাকবে না। এখানে একটি কথা বলা বাঞ্ছনীয়, পৃথিবীর কোনো দেশই তার টেকসই কৃষি ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে শিল্পে এগোতে পারেনি।  আমরা শিল্পকারখানা নির্মাণে ম েনাযোগী হচ্ছি পরিবেশগত সুরক্ষাকে প্রাধান্য না দিয়েই, যা হতে নির্গত সিএফসি গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণায়নের  জন্য অন্যতম দায়ী।

অন্যদিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যা শীর্ষ কার্বন নিঃস্বরণকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত, তা আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ দেশে তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে পৃথিবীর অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে আসার ঘোষণা দিচ্ছে, সেখানে ইতোমধ্যে আমরা মোট ২১টি কয়লা প্ল্যান্টর চুক্তি করে ফেলেছি (বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে)। মার্কেট ফোর্সেস ও থ্রি ফিফটি’র যৌথ গবেষণা, ২০১৯-এর তথ্য মতে, এতগুলো কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ১১৫ মিলিয়ন টন বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইডের কবলে পড়বে বাংলাদেশ।

তদুপরি ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইনেরও কার্যকর প্রয়োগ হচ্ছে না। যত্রতত্র স্থাপনকৃত ইটভাটার ধোঁয়া প্রতিনিয়ত পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। জাতিসংঘের ধারণা মতে, ইটভাটার মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশ সবচাইতে বেশি দূষিত হয়। এসব পরিবেশ বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড মারাত্মক প্রাণঘাতী রোগ, যেমন ক্যানসার, হূদরোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা ও স্নায়ুবিক দুর্বলতার মতো ভয়ানক সব রোগের সৃষ্টি করে। ২০১৯ সালের বিশ্বব্যাংক কর্তৃক একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ২৮ ভাগেরই কারণ পরিবেশ দূষণজনিত অসুস্থতা। অন্যদিকে সারা বিশ্বে এ ধরনের  মৃত্যুর হার গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। এ দ্বারাই বোঝা যায় আমরা পরিবেশগত ভাবে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছি।

পৃথিবীর কোনো দেশই পরিবেশকে প্রাধান্য না দিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে নি। উন্নয়ন ও পরিবেশ কখনোই সাংঘর্ষিক নয়, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেই উন্নয়ন করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। আমাদেরও উচিত পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে এমন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা এবং আমাদের ফুসফুস খ্যাত পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ক্ষতি সাধন করে এমস কোনো প্রকল্প গ্রহণ না করা। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা এবং কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য সবুজ বিদ্যুতের কার্যক্রম হাতে নেওয়া। নবায়নযোগ্য সবুজ শক্তি নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ, জ্বালানি বৈচিত্র্যের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণেও সহায়তা করে। এক্ষেত্রে সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে করা অঙ্গীকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা জরুরি হয়ে উঠেছে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads