পৃথিবীজুড়ে অতিমারি করোনার ভেতরেও বাংলাদেশের অর্থনীতি যে একেবারে ভেঙে পড়েনি, তার প্রমাণ আমাদের পোশাকশিল্পের বর্তমান অবস্থা। বিদেশি বায়াররা ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির প্রথম পর্যায়ে উচ্চ মূল্যের অর্ডার বাতিল করলেও, পাশ্চাত্য দেশগুলোর করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও, যখন বাংলাদেশে করোনা ততটা আঘাত হানেনি, তখন তারা আবার ফিরতে শুরু করে। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মারাত্মক আকারণ ধারণ করলেও আমাদের নীতিনির্ধারকদের কৌশলী পদক্ষেপের কারণে পোশাকশিল্পে এর প্রভাব অতটা পড়েনি। আর তাই বর্তমানে করোনার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক বা জাতিসংঘও এখন আশার কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলেও ২০২৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা পাবে। দুই ধাপে তিন বছর করে বাংলাদেশের পণ্য যুক্তরাজ্যের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি পাবে। বিশেষ করে উচ্চমানের সেবা খাতসহ যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাংলাদেশে ব্যবসার সুযোগ বাড়ছে। রপ্তানিভিত্তিক বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার অংশ হিসেবে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলেও দুই ধাপে তিন বছর করে যুক্তরাজ্যের বাজারে জিএসপি সুবিধা পাবে। প্রথম ধাপে ২০২৪ সাল আর দ্বিতীয় ধাপে ২০২৭ সাল পর্যন্ত জিএসপি সুবিধা পাবে। তার মানে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য এ সময় পর্যন্ত শুল্ক আর কোটামুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। এরপর কী ঘটবে, সেটা নির্ভর করবে আমাদের জিএসপি নীতিমালা কেমন হবে, তার ওপর। অর্থাৎ আগামী ছয় বছর যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশ অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পেতে থাকবে। আমাদের বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে এটি কাজে লাগাতে হবে।
মনে রাখতে হবে, রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত এখন পোশাক শিল্প। মূলত সস্তা শ্রমের বদৌলতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের উত্থান ঘটেছে। সত্তর আশির দশকে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু। পোশাক শিল্পে নিয়োজিত কর্মীদের নৈপুণ্য, আন্তরিকতা ও ভাল মানের কাজের কারণেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে পোশাক শিল্প উন্নত বিশ্বের নজর কাড়ে। তর তর করে সমৃদ্ধ হতে থাকে পোশাক খাত। বিদেশি বায়ারদের চাহিদার কারণেই যত্রতত্র যেনতেন ভাবে নন কমপ্লায়েন্স হিসেবে পোশাক কারখানা গড়ে ওঠায় নিয়োজিত কর্মীদের কর্মকালীন নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল। এরই মধ্যে ২০১২ সালে তাজরিন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১১০ জন শ্রমিকের মৃত্যু বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ওপর অশনিসংকেত হিসেবেই দেখা দেয়। এ ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই সাভারে রানা প্লাজা ধসে প্রায় ১১০০ কর্মীর অকাল মৃত্যু ও শতশত আহত শ্রমিকের আহাজারির কারণে ক্রেতা দেশগুলো কমপ্লায়েন্সের অভিযোগ তোলে।
এরপর ২০১৩ সালে পোশাকশিল্পে নিরাপত্তাজনিত অভাব ও নন-কমপ্লায়েন্স কারখানার তৈরি পোশাক আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতেই যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক মুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানি বা জিএসপি স্থগিত করে। এতে করে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মূলত বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। যারা জিএসপি সুবিধা বহাল রেখে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোকে কমপ্লায়েন্স হিসেবে সংস্কার করতে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মাধ্যমে তদারকি শুরু করে। টানা কবছর ধরে অ্যার্কড ও অ্যালায়েন্সের প্রত্যক্ষ তদারকিতে দেশের পোশাক কারখানাগুলোর সংস্কার চলে। শেষ পর্যন্ত অ্যার্কড ও অ্যালাইন্সের তরফে কমপ্লায়েন্স কারখানার সনদ দেওয়া হয়। এরপরও কিন্তু বাংলাদেশি পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি পুনর্বহাল করেনি। এর বিপরীতে যুক্তরাজ্যের ইতিবাচক ভূমিকা আমাদের পোশাকশিল্পের জন্য শুভ বার্তা বয়ে এনেছে।
তবে জিএসপি স্থগিত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে। একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। যদি জিএসপি সুবিধায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির সুযোগ থাকত, তাহলে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে যেত। যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিটি পণ্যে অন্তত ১৫ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করছে জিএসপি সুবিধায়। এখন পোশাক খাতে বলতে গেলে কমপ্লায়েন্সের কারণে দুর্ঘটনা নেই বললেই চলে। এরপরও কোন যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য আমদানিতে জিএসপি সুবিধা বন্ধ রেখেছে, যা আমাদের বোধগম্যের বাইরে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয় ও ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় ফিরে আসায় অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা (জিএসপি) ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশটির বাজারে স্থগিত থাকা জিএসপি সুবিধা ফিরে ফেতে আবারো দরকষাকষি করবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়। বাণিজ্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে জো বাইডেনের উদারনীতির কারণে বাংলাদেশের একক শীর্ষ রপ্তানির দেশ যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি পুনর্বিবেচনায় নিতে পারে। তবে এ জন্য এখনই অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।
আশার কথা হচ্ছে, বর্তামন করোনা ভাইরাস সৃষ্ট কঠিন সময়েও পোশাক রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখেছে বাংলাদেশ। সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সূত্র অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) নির্ধারিত ৩০.৭৬ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩০.৮৬ বিলিয়ন ডলার। ইপিবির গত বছরের পরিসংখ্যানের বিবেচনায় সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার বা প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে রপ্তানির হিসাব করেছে বিজিএমইএ। তবে রপ্তানির হিসাব প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠান ইপিবি এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করেনি। করোনা ভাইরাসের কঠিন পরিস্থিতিতেও তৈরি পোশাক রপ্তানির এমন চিত্রে আশাবাদী রপ্তানিকারকসহ সংশ্লিষ্টরা। পোশাক রপ্তানিকারকরা আগামী মাসগুলোতে ভালো রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছেন। মূলত ভারত, চীন ও মিয়ানমার থেকে কিছু রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশে আসতে শুরু করায় এখন কারখানাগুলোর কাজ বেড়েছে।
তবে পোশাকের প্রধান কাঁচামাল তুলার দাম এবং পরিবহনসহ ফ্রেইট খরচ বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে ক্রমাগত পোশাকের দর কমে যাওয়ায় রপ্তানিকারকরা উদ্বিগ্ন। একই সঙ্গে যেসব ক্রেতা নতুন করে বাংলাদেশে আসছে, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসা করার সূচকে প্রত্যাশিত অগ্রগতি করতে না পারায় তাদের ধরে রাখা যাবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। সুতরাং অবকাঠামোগত সমস্যা ও অব্যবস্থাপনার জন্য পণ্য রপ্তানিতে বিলম্ব না হলে আয়ের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে এ কথা বলা যায়। আমাদের এখন সেদিকেই নজর দিতে হবে।
বিআইবিএস-এ অনুষ্ঠিত ‘ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন ইন আরএমজি বাই ব্যাংকস : রিক্্স অ্যান্ড সিটিগেশন টেকনিকস’ শীর্ষক কর্মশালায় উত্থাপিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ গোটা বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে। তবে অবকাঠামোগত সমস্যা ও ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যার কারণে প্রায় ৬৫ শতাংশ রপ্তানি সঠিক সময়ে হয় না, যা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রপ্তানি বাড়াতে হলে অবকাঠামো ও বন্দর ব্যবস্থাপনার দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। সড়কে যানজট ও বন্দরের জটের কারণে পণ্য রপ্তানিতে অনেক সময় বিলম্ব হয়। এ অভিযোগটি অনেক পুরনো। তবে, মহাসড়কগুলোর চার লেনের কাজ সমাপ্ত হলে যানজটের পরিমাণ কমে আসবে, তখন বন্দরের জটও অনেকাংশেই কমে আসবে। যদি অবকাঠামোগত সমস্যা ও বন্দর জট না থাকে তাহলে লক্ষ্যমাত্রার পুরোটাই অর্জিত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। যেহেতু দেশে গ্যাস একটি বড় ধরনের সমস্যা। এ সমস্যাকে রোধ করতে না পারলে উৎপাদনের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে না। আমরা আশাবাদী, সরকার যানবাহন, বাসাবাড়িতে গ্যাসের শতভাগ ব্যবহার বন্ধ করে পোশাক কারখানাগুলোকে চালু রাখলে এবং গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারলে অবকাঠামোগত সমস্যা অনেকাংশেই কমে আসবে।
অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো সেবা খাতকে উৎপাদনমুখী করতে না পারলে ব্যবসায়ীদের শত চেষ্টাতেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। যেহেতু আমাদের সমৃদ্ধ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান পোশাক খাতের ওপর ৮০ ভাগই নির্ভরশীল, সেহেতু শত প্রতিকূলতার মাঝেও পোশাক খাতকে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। তাহলে রপ্তানি আয়ের ওপর আমাদের অর্থনীতির টেকসই সমৃদ্ধি অর্জন করা অনেকাংশেই সহজ হবে।
লেখক : সমাজ বিশ্লেষক





