একটি নির্বাচন, দৃষ্টি ছিল সারা বিশ্বের। আগ্রহ ছিল, অপেক্ষা ছিল আবার উৎকণ্ঠাও ছিল। নির্বাচনটা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপার পাওয়ারের হয় তাহলে দৃষ্টি সেদিকে থাকারই কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন গণতন্ত্রের দেশ। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক কৌশল কী হবে তা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করা শুরু হয়েছে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকলে যে কৌশল অবলম্বন করতেন বাইডেন যে তার থেকে ভিন্ন হবেন তা অন্তত বোঝা যায়। জো বাইডেনের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের যেমন দাবি রয়েছে, তেমনি বিশ্বেরও এক ধরনের দাবি রয়েছে। তা হলো বিশ্বকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়া। যুদ্ধ বা রাজনৈতিক অস্থিরতার সমাধানে ভূমিকা রাখা। জলবায়ু পরিবর্তনের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখা। অভিবাসীদের জন্য পরিকল্পনা করা। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বজায় রাখা। এতদিন কে যাবেন হোয়াইট হাউজে তাই নিয়ে ছিল আলোচনা। আলোচনার কারণও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি ক্ষমতাধর দেশ এবং তার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন যা আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ। বহু ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে হোয়াইট হাউজে যাবেন জো বাইডেন। জো বাইডেন, একজন শান্ত, ধৈর্যশীল রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। তিনি ফলাফলের শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন। অপেক্ষা করেছিলেন প্রতিটি ভোট গণনা হওয়ার। মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টও তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রেসিডেন্টও তিনি। জো বাইডেন আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন একজন মানুষ। যে নিজের সন্তান মারা যাওয়ার পর থেমে না গিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছেন। তার বাবার একটি কথা তাকে অনুপ্রেরণা দেয়। তিনি বলেছিলেন, তোমাকে কে কতবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সেটি বড় কথা নয়। তুমি কত দ্রুত উঠে দাঁড়াতে পেরেছ সেটাই তোমার সাফল্যের পরিচায়ক। এজন্যই তিনি দুই বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হতে না পারা, তারপর ২০১৫ সালে সন্তানের মৃত্যু এবং এবছর আরেক জনপ্রিয় প্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্সের সঙ্গে প্রাইমারিতে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চূড়ান্ত প্রার্থী হওয়া। এসব কিছুই তার চরিত্রের দৃঢ়তা নির্দেশ করে। তিনি বলেছেন, আমরা প্রতিপক্ষ কিন্তু শত্রু নই। রাজনীতি মানে তো সবাই মিলে এগিয়ে যাওয়া। শুদ্ধ রাজনীতি এটাই নির্দেশ করে।
ট্রাম্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে তা অনুমেয়ই ছিল। নির্বাচনী যুদ্ধ ছিল তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ। ট্রাম্পের অভিযোগ আর বাইডেনের অপেক্ষা। নির্বাচনের ফল প্রকাশে বিলম্বের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি রাজ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। নির্বাচন নিয়ে একের পর এক অভিযোগ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও ট্রাম্পের সেসব অভিযোগ শেষ পর্যন্ত টেকেনি। করোনা মার্কিন রাজনীতিতে একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তা বাইডেনের বিজয়ের পর ভালোভাবেই টের পাওয়া গেছে। করোনা নিয়ে ট্রাম্পের প্রথম থেকে মন্তব্য সবসময়ই সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সারা বিশ্ব যেখানে মাস্কের ব্যবহারের কথা বলছে সেখানেও ট্রাম্পের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তার সাম্প্রদায়িক এবং বর্ণবাদ মনোভাবও তার জন্য বিপরীত ফল বয়ে এনেছে বলা হচ্ছে। নিজে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরও সমালোচনা পিছু ছাড়েনি। অবশ্য ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ট্রাম্প বিশ্বের দৃষ্টি নিজের দিকে টেনে নেয়। মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন—স্লোগানে ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প আসলে কতটা গ্রেট করেছে নাকি যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন হয়েছে বিশ্ব থেকে সে হিসাবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেখানকার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। কারণ এখন সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখ ৪৪ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত এক কোটি পেরিয়ে গেছে। সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সংখ্যা বাড়ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য এখনো বাকি থাকলেও বাইডেন করোনা সংকট নিয়ন্ত্রণে হাত দিয়েছেন। জো বাইডেন প্রথমেই করোনা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়েছেন। এটাই এখন প্রথম প্রায়োরিটি। করোনা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা ছাড়াও সবার জন্য বিনামূল্যে ভ্যাকসিনের পরিকল্পনা, মাস্ক বাধ্যতামূলক করা, অর্থনীতি, অভিবাসন, পররাষ্ট্রনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু ও জ্বালানি, বিচারব্যবস্থায় সংস্কার ও কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক বিষয়ক পরিকল্পনা রয়েছে।
এক কোটি দশ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা প্রদান, করোনা ছাড়াও জো বাইডেনের বিজয়ের কারণ তার ইস্যুগুলো জনগণকে টানতে পেরেছে। তিনি জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছেন। একজন রাজনীতিক যখন এটা বোঝাতে সক্ষম হবেন যে তিনি তাদের জন্য কাজ করতে চান তাহলে জনগণও তার সঙ্গেই থাকে। করোনা নিয়ন্ত্রণে জোরদার, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে জোর দেওয়া, অভিবাসী ইস্যুসহ কয়েকটি ইস্যু। যেসব ইস্যুতে ট্রাম্প গুরুত্বারোপ করেননি। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সাফল্যের মধ্যে ছিল মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। যা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসা কুড়িয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিবর্তন এসেছে বা আরো পরিবর্তন আসতে চলেছে তার অন্যতম কারিগর ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিভিন্ন মাধ্যমের করা জরিপের ফলাফলে জো বাইডেন এগিয়ে ছিল সবসময়। শেষ দিকের জরিপে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলেছিল। হয়েছেও তাই। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জরিপের ফল কাজে না আসলেও এবার আর তা হয়নি। হেরেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। জরিপ নিয়ে যার বেশি মাথা ব্যথা ছিল না। ব্যালটে নেওয়া ভোটে এবার সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে। জো বাইডেন শুরু থেকেই নিজেকে ক্লিন ইমেজের মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। জো বাইডেনের সঙ্গে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, যিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
করোনা ইস্যু ছাড়াও আরো একটি ইস্যু এই নির্বাচনে প্রভাব রেখেছে তা হলো ব্লাক লাইভস ম্যাটারস আন্দোলন। যে আন্দোলন শুরু হয়েছে জর্জ ফ্লয়েড মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। এটা যে নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে তা আগেই অনুমেয় ছিল। ট্রাম্পের আস্থা ছিল অর্থনীতি ও বেকারত্ব হ্রাসের মতো সাফল্যে। পরিসংখ্যানও ইতিবাচক ছিল। মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের তথ্যে, আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বেকারত্বের হার কমে ৮ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে যা গত জুন মাসে ১০ দশমিক ২ শতাংশ এবং এপ্রিলে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল। করোনা সেই পরিস্থিতি প্রতিকূলে নিয়ে যায়। বিজয়ের প্রথম ভাষণে জো বাইডেন বিভক্তি দূর করে ঐক্যবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন। জলবায়ু একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে এবং করোনার পরে এটাই হবে বিশ্বের চ্যালেঞ্জ। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই বিশ্ব আশা করে। বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ট্রাম্পের সময়কালের বেশিরভাগ সময়ই উঠতি পরাশক্তি চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব চলেছে। যাতে দুই দেশেরই ক্ষতি হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাইডেনের কৌশল কী হবে তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে। জো বাইডেনের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ আস্থা রেখেছেন। সেই আস্থার মূল্যায়ন তাকে করতে হবে। সেই সঙ্গে বিশ্বকে একটি সঠিক পথে নেওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
sopnil.roy@gmail.com