রাসায়নিক সার, কীটনাশক, গ্রোথ হরমোনসহ যে-কোনো রাসায়নিক পদ্ধতি ছাড়া জৈবসার ও জৈব কীটনাশক দিয়ে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসল উৎপাদন করাই অরগ্যানিক ফার্মিং বা জৈব কৃষি। অরগ্যানিক ফুড বা জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত খাদ্যের প্রতি সারা পৃথিবীর মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। কারণ রাসায়নিক সার দিয়ে ফসল চাষাবাদ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফসল উৎপাদন খরচও বেশি হয়। জৈবসার দিয়ে ফসল চাষাবাদ পরিবেশসম্মত ও উৎপাদন খরচ কম হয়। উৎপাদিত খাদ্য হয় স্বাস্থ্যসম্মত। বাংলাদেশে শাকসবজি উৎপাদনে প্রচুর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় ইউরোপের দেশগুলো এদেশ থেকে শাকসবজি ক্রয়ে অনীহা প্রকাশ করেছে। ‘বিশ্ব জৈব কৃষি ২০১৮ : পরিসংখ্যান ও দ্রুত বর্ধনশীল প্রবণতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অরগ্যানিক চাষাবাদ পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর তথ্য রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে এখন ৫৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন হেক্টরে অরগ্যানিক খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে, যা মোট জমির ১ দশমিক ২ শতাংশ। এশিয়া মহাদেশে সার্বিক অরগ্যানিক চাষাবাদের হার দশমিক ৩ শতাংশ। এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে চীন। আর সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সবচেয়ে তলানিতে। অরগ্যানিক চাষাবাদে শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান তুলনামূলকভাবে বেশ এগিয়ে।
নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা ও চাষাবাদ বাড়ছে
বিশ্বব্যাপী এই নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে চাষাবাদও। কিন্তু সেই তুলনায় কৃষিনির্ভর দেশ হয়েও অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। এখনো বিশ্বের যেসব দেশে মোট চাষযোগ্য জমির মাত্র এক শতাংশ জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হয়, সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানও রয়েছে। তাও আবার অনেক দেশের পেছনে। বাংলাদেশে মাত্র ৮ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হচ্ছে। এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই বাংলাদেশের চেয়ে বেশি অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদন হয়। সম্প্রতি ‘বিশ্ব জৈব কৃষি ২০২১ : পরিসংখ্যান ও দ্রুত বর্ধনশীল প্রবণতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাবিশ্বে এখন ৫৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হচ্ছে, যা মোট জমির ১ দশমিক ২ শতাংশ। এশিয়া মহাদেশে সার্বিক অরগ্যানিক চাষাবাদের হার দশমিক ৩ শতাংশ। এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে চীন ও ভারত। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ। অরগ্যানিক চাষাবাদে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান।
বিশ্বের ১৭৯টি দেশে অরগ্যানিক কৃষিপণ্যের আবাদ করা হচ্ছে। বিশ্বের ২৪ লাখ কৃষক এখন প্রায় ৫ কোটি ১০ লাখ হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক কৃষিপণ্যের আবাদ করছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃষক রয়েছে ভারতে ৫ লাখ ৮৫ হাজার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইথিওপিয়ায় অরগ্যানিক কৃষিপণ্য উৎপাদনকারীর সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ৬০২। ২ লাখ কৃষক নিয়ে পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো। অন্যদিকে জমি আবাদের দিক থেকে শীর্ষ তিনে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় ২ কোটি ২৭ লাখ হেক্টর, আর্জেন্টিনায় ৩১ লাখ ও যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক কৃষিপণ্য আবাদ হচ্ছে। ইউরোপীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফআইবিএলের এক গবেষণায় দেখা যায়, গত এক দশকে অরগ্যানিক কৃষি পণ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০০ শতাংশ। অরগ্যানিক পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স। আগামী কয়েক বছরে এটি ১৩৮ বিলিয়র ডলারে দাঁড়াবে। ১৬৪ দেশে বর্তমানে সার্টিফাইড অরগ্যানিক পণ্য সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করছে। এর বেশির ভাগ দেশই বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত। তাই একটি কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
অরগ্যানিক চাষে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে ইউরোপ। মোট অরগ্যানিক চাষের ২৫ শতাংশ হয় এই মহাদেশে। ৯৩ লাখ হেক্টর জমির এই চাষাবাদে আড়াই লাখেরও বেশি খামার জড়িত। আফ্রিকায় ১০ লাখ হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয় এবং প্রায় ৫ লাখ কৃষক এর সাথে জড়িত।
জমির জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য বাড়ায় উর্বরতা বৃদ্ধি করে
রাসায়নিক সারের পরিবর্তে উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন প্রযুক্তিতে উৎপাদিত জৈবসার সবজি ও ধান গাছে প্রয়োজনীয় ইউরিয়া, পটাশ ও ফসফেট সারের জোগান দেয়। আধা-কম্পোস্ট গোবর, মুরগির বিষ্ঠা, ধানের কুঁড়া, মাছ-মুরগির পাখনা ও পরিপাকতন্ত্র তথা পরিত্যক্ত অংশ একসাথে করে জৈব কম্পোস্ট সার তৈরি করা হয়। জৈবসার প্রয়োগ করলে আর অতিরিক্ত ইউরিয়া, পটাশ ও টিএসপি সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয়না। এ ছাড়া মাটির উর্বরতা ও স্বাস্থ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়। উৎপাদিত ফসল হয় স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ। অরগ্যানিক ফার্মিং জমির জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য বাড়ায়, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি জমির প্রবল বৃষ্টিপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, যে জমিতে সর্বশেষ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে চাষাবাদ করা হয়েছে সেই জমি ন্যূনতম তিন বছর পতিত অবস্থায় ফেলে রাখলে বা পুনরায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ ছাড়া চাষ করলেই অরগ্যানিক খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব। কারণ চাষাবাদে ব্যবহূত বহুল প্রচলিত রাসায়নিক সারের অবশিষ্টাংশ তিন বছরে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অরগ্যানিক ফার্মিংয়ে বা জৈব কৃষিতে কৃত্রিম কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না বটে, কিন্তু সমালোচকরা বলেন, বহু প্রকৃতিদত্ত কীটনাশক পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর নয়। জৈবসার দিয়ে চাষ করলে প্রথম এক থেকে দুবছর ফলন কিছুটা কম হবে। তবে চার থেকে পাঁচ বছর পর রাসায়নিক সার দিয়ে চাষ করা জমির তুলনায় ফলন বেশি হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৫২ লাখ হেক্টর। আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ সাড়ে ৮৫ লাখ হেক্টর। প্রায় দেড় কোটি কৃষি পরিবার এই জমির প্রায় শতকরা ৮৮ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এদের অধিকাংশই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক। বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩.৫ শতাংশ থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও এ দেশের বেশির ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১-১ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং কিছু কিছু জমিতে এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়েও কম। এর মধ্যে ৩৭ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৭ দশমিক ২ লাখ হেক্টর জমিতে পটাশিয়াম, ৩৩ দশমিক ১ লাখ হেক্টর জমিতে গন্ধক, ২৭ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর জমিতে দস্তা, ২৪ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরন, ৩৫ দশমিক ৬ লাখ হেক্টর জমিতে অত্যধিক থেকে অধিক অন্তের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া অনেক জমিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব।
অরগ্যানিক ফুড স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিসমৃদ্ধ
অরগ্যানিক ফুড নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। গবেষণার বিষয় হলো ‘অরগ্যানিক ফুড অ্যান্ড ফার্মিং মিথ অ্যান্ড রিয়ালিটি’। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রমাণ করেছে, অরগ্যানিক খাদ্যে রাসায়নিক মাত্রা কম থাকে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়ে উৎপাদিত খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকায় ক্যান্সার, প্রজননক্ষমতা হ্রাস, পেটের রোগ, হূদরোগ, ফুসফুসের রোগসহ বিভিন্ন রোগ হয়। জার্মানিতে ১২ বছরব্যাপী এক গবেষণায় দেখা গেছে, অরগ্যানিক খাদ্যেও পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন সি বেশি থাকে নন অরগ্যানিক খাদ্যের চেয়ে। মার্কিন এক গবেষণায় জানা যায়, নন
অরগ্যানিক খাদ্যেও চেয়ে অরগ্যানিক খাদ্যে ক্যালসিয়াম ৬০ শতাংশ, আয়রন ৭৩ শতাংশ, পটাশিয়াম ১২৫ শতাংশ ও জিংক ৬০ শতাংশ বেশি থাকে। এছাড়াও অরগ্যানিক খাদ্যে বিষাক্ত পদার্থ লেড (পারদ) ২৯ শতাংশ কম পাওয়া গেছে। অরগ্যানিক খাদ্যে ফাইটো কেমিক্যাল বেশি থাকায় স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
জৈব কৃষিপদ্ধতি উচ্চ পানি ধারণক্ষমতার জন্য উক্ত অবস্থায়ও শস্য উৎপাদনে সক্ষম। জৈব কৃষিপদ্ধতি কৃষকদের জন্যও লাভজনক। কারণ এই পদ্ধতি কৃষিকাজে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে, পরিবেশগত ক্ষতি পোষাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দক্ষিণ কোরিয়ার পালডাংয়ের জানজিতে অনুষ্ঠিত ১৭তম বিশ্ব অরগ্যানিক সম্মেলনে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড অপরচুনিটিস অন অরগ্যানিক ফার্মসের (ডব্লিউডব্লিউওওএফ-বাংলাদেশ) পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জমির এ সম্ভাবনাময় দিক উপস্থাপনার মাধ্যমে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো বলছে, জৈব চাষের জন্য বাংলাদেশের জমি সবচেয়ে উপযুক্ত। তাদের মতে, বাংলাদেশের মাটির ভলিউম এবং সূর্যালোকের প্রাচুর্যের কারণেই খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি সমানুপাতিক হারে বায়োমাস তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ডব্লিউডব্লিউওওএফ-বাংলাদেশের ওই উপস্থাপনায় বলা হয়, বাংলাদেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় এখানে প্রাকৃতিক কৃষি চাষাবাদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এখানে তাপমাত্রা কখনো মাইনাসের নিচে নামে না। ফলে সারা বছর প্রকৃতিতে জৈব উপাদানের প্রাচুর্য বজায় থাকে। এর ফলে গাছপালাও পুষ্ট হয়, প্রকৃতিও সতেজ ও সবুজ থাকে। এ আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে প্রাকৃতিক চাষাবাদে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ, যা সারা বিশ্বের জন্য মডেল হতে পারে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, জৈবভাবে উৎপাদিত শস্য প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত শস্যের চেয়ে ১৮০ গুণ কম রাসায়নিক পদার্থ পরিবহন করে যা মূলত আসে অজৈব সার এবং কীটনাশক থেকে। জৈব কৃষিক্ষেত্র মাটিতে অধিক কার্বন সংরক্ষণে সহায়তা করবে এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে মাটির পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধি করবে। এটি মাটি এবং পানিদূষণ কমানোর পাশাপাশি গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে ভূমিকা পালন করবে।
অরগ্যানিক চাষাবাদে ভালো অবস্থানে রয়েছে চীন ও ভারত
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা পত্রে দেখা গেছে, দেশের মোট জমির অন্তত ১০ শতাংশ অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। বিশেষজ্ঞগণের মতে, অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অরগ্যানিক সুগন্ধি চাল, শাকসবজি, ফল, মাশরুম, চা, অরগ্যানিক পাট, অরগ্যানিক মাছ ও অরগ্যানিক মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রেই বেশি নজর দিতে হবে। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইনকানুন তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদনের উপযুক্ত জমি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, নদী ও উপকূলীয় চরাঞ্চল এবং বসতভিটার আঙিনা ও চারপাশ এবং নগর এলাকার বাড়িঘরের ছাদগুলো নির্বাচন করা যেতে পারে।
‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব অরগ্যানিক অ্যাগ্রিকালচার স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড এমার্জিং ট্রেন্ড ২০১৮’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অরগ্যানিক অ্যাগ্রিকালচার এফআইবিএল। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশার। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশে অরগ্যানিক চাষাবাদের জমি বাড়ছে না। ২০১৬ সালে ১০১টি অরগ্যানিক চাষাবাদের প্রকল্প চালু ছিল বাংলাদেশে; যাতে ৯ হাজার ৩০৩ জন উদ্যোক্তা সম্পৃক্ত রয়েছেন। তবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার অরগ্যানিক চাষাবাদ বাড়াতে ‘ন্যাশনাল অরগ্যানিক অ্যাগ্রিকালচার পলিসি-২০১৬’ বাস্তবায়ন ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ন্যাশনাল অরগ্যানিক স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড’ গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে, যদিও সেটি এখনো পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে মাত্র ছয় হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক পণ্যের চাষাবাদ হচ্ছে, যা মোট আবাদি জমির মাত্র দশমিক ১ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বর্তমানে ৫৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হচ্ছে, যা মোট জমির ১.২ শতাংশ। অপরদিকে এশিয়া মহাদেশে অরগ্যানিক চাষাবাদের হার দশমিক ৩ শতাংশ। অরগ্যানিক চাষাবাদে এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে চীন ও ভারত। আর সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। অরগ্যানিক কৃষি প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি একবারে কম নয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রত্যাশা ভবিষ্যতে বিজ্ঞানভিত্তিক অরগ্যানিক পণ্যই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে এবং বিদেশে রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলার আয় করবে। এতে কৃষক পণ্যের অধিক মূল্য পাবেন এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশও থাকবে দূষণমুক্ত। বাংলাদেশ অরগ্যানিক প্রডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারি অ্যাসোসিয়েশন (বিওপিএমএ)-এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে দেশের এক লাখ একর জমিকে অরগ্যানিক কৃষির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে পুরো দেশকে অরগ্যানিক কৃষির আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে সংস্থাটি কাজ করছে।
আইপিএম পদ্ধতিতে চাষাবাদ
বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘আইপিএম কার্যক্রম’ জৈব কৃষির বিস্তারে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগ ‘আইপিএম’ পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ পদ্ধতিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের খেতের পোকা দমন করা হয়, যাতে করে রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর কৃষকের নির্ভরতা কমে আসে। ‘আইপিএম পদ্ধতির’ বা ‘সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার’ মাধ্যমে বালাই দমন ব্যবস্থাপনায় যেসব উপাদান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উপকারী বন্ধু পোকার লালন ও পোকার সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা। জৈব কৃষিতে উৎপন্ন শাকসবজি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের বাজারে রপ্তানির কার্যক্রম আমাদের কৃষিকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারে, বয়ে আনতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এ লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশে চলছে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা সহযোগিতামূলক গবেষণা সহায়তাকারী কার্যক্রম। বাংলাদেশের বিএআরসি, বারি, ব্রি, বিজেআরআই, বিএসআরআই, বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। জানা গেছে, ২০০৫ সালের গোড়ার দিকে ‘উজবেকিস্তান সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের’ কৃষিবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের কয়েকজন কৃষিবিদের কাছে ‘উপকারী বন্ধু পোকার’ বাণিজ্যিক উৎপাদন কৌশল হস্তান্তর করেন। একই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী কিছু পোকার সেক্স ফেরোমন উৎপাদন কৌশল হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন। তখন থেকেই যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে উপকারী বন্ধু পোকা ও পোকার সেক্স ফেরোমন ফাঁদ উৎপাদন। সফল গবেষণার পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘আইপিএম’ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন ফসল উৎপাদন এলাকায় উপকারী বন্ধু পোকা ওপোকার সেক্স ফেরোমন কৃষকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কৃষকরা সানন্দে এগুলো গ্রহণ করেছেন এবং এর সুফল পেতে শুরু করেছেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও জৈব কৃষি দ্রুত প্রসার লাভ করছে। বেসরকারি উদ্যোগগুলোর মধ্যে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), উবিনীগ, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড, শিসউক ও বিসেফ ফাউন্ডেশন এই পাঁচ সংগঠনের যৌথ প্রচেষ্টা বাংলাদেশ ফুড সেফটি নেটওয়ার্ক (বিএফএসএন)। এই নেটওয়ার্ক জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহযোগিতায় ২০১০ সালে গঠিত হয়। বর্তমানে এফএওর কারিগরি সহযোগিতায় ও বাংলাদেশ সরকার ও নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় দেশব্যাপী নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো জৈব কৃষি আন্দোলন অন্যতম।
কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং কলাম লেখক,
ই-মেইল : writetomukul36@gmail.com