মানুষ, জীব-জন্তু, সবই মহান আল্লাহর সৃষ্টি। মহান আল্লাহতায়ালা যেমনি মানব ও জীন তৈরি করেছেন তেমনি জীব-জন্তুও তৈরি করেছেন তিনি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু মানবজাতির প্রতি দয়ালু ছিলেন না। তিনি বিশ্বব্যাপী মাখলুকাতের প্রতিও দয়ালু ও দয়াবান ছিলেন। যারা নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কথা মানুষের মতো স্বাভাবিকভাবে অন্যের নিকট ব্যক্ত করতে পারে না। সেসব বাকহীন জীব-জন্তু ও পশু-পাখির দুঃখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণ আকুল হতো। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন রহমাতুল্লিল আলামিন বা সারা বিশ্বজাহানের জন্য রহমতস্বরূপ। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্বজাহানের প্রতি রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৭)
প্রাণিজগতের সাথে কীরূপ আচরণ করতে হবে সে সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল জাহেলি যুগের মানুষরা। তারা পশুর সাথে পশুর মতো আচরণ করত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা শরিফে তাশরিফ নেওয়ার পূর্বে সেখানকার লোকজন জীবিত উটের কুঁজ ও দুম্বার পেছনে বাড়তি গোস্ত কেটে খেত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবন্তপশুর প্রতি এরূপ জাহেলি আচরণ করতে নিষেধ করেছেন। যে জন্তুকে সাওয়ারের জন্য ব্যবহার করা হয়, সেসব জন্তুর উপর লাগাম বা জ্বিন বেঁধে তাকে কষ্ট দিতে এবং হয়রানি করতে নিষেধ করেছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। একটি উটের পাশ দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাচ্ছিলেন, তখন লক্ষ করলেন-প্রচুর ক্ষুধার তাড়নায় উটের পিঠ পেটের সাথে মিশে গেছে। এ দৃশ্য দেখে রহমতের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা এসব বাকশক্তিহীন পশুদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালাকে ভয় কর। যখন এরা সুস্থ, সক্ষম থাকে তখন এদের উপর আরোহণ কর। যখন ক্লান্ত হয়, এদের ছেড়ে দাও। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমার ঘোড়ার কপালে পশম, ঘাড়ের পশম ও লেজের পশম কর্তন করবে না। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক আনসারির বাগানে প্রবেশ করে সেখানে অবস্থানরত একটি উট রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে কাঁদতে লাগল। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটের কাঁধ ও মাথার পেছনের অংশ হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর কান্না বন্ধ হয়ে গেল। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এই উটটি কার? তখন আনসার যুবকটিকে বললেন, আমার। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ এই পশুর মালিক তোমাকে বানিয়েছেন, অথচ তুমি কি এ ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালাকে ভয় করছ না? এই উট তোমার বিরুদ্ধে আমার নিকট নালিশ দিয়েছে। তুমি তাকে ক্ষুধার্থ রাখ এবং তাকে দিয়ে বেশি বোঝা বহন করাও। কিন্তু তাকে চাহিদা মোতাবেক খাবার দাও না।’ (সুনানে আবু দাউদ)
জীব-জন্তুকে কষ্ট দেওয়া এবং হয়রানি করা যাবে না। মনের শখ বা ফুর্তির জন্য অন্যায়ভাবে জীব-জন্তু ও পশু-পাখি অযথা হত্যা করাকে ইসলাম কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। প্রাণীকে অন্যায়ভাবে আহত করা যাবে না। একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশ দিয়ে একটি গাধা গমনকালে তিনি দেখতে পেলেন যে, তার মুখমণ্ডলে জলন্ত লোহা দিয়ে দাগ দেওয়া হয়েছে। তখন তিনি বললেন, সে ব্যক্তির উপর লানত যে তার মুখে দাগ দিয়েছে। কারণ পশুর মুখে দাগ দিলে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি ঘটে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাঙ বধ করতেও নিষেধ করেছেন। পিঁপড়াকে পুড়িয়ে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আগুন দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া কেবল রব ছাড়া আর কারো জন্য সংগত নয়।’ (আবু দাউদ, তিরমিযি)
পশু-প্রাণীকে শাস্তি না দিয়ে ভালোবাসা একান্ত কর্তব্য। যে চতুষ্পদ জন্তুর প্রতি দয়া দেখাবে সে সওয়াবের অধিকারী হবে। বনী ইসরাইলের অপরাধী মহিলা পিপাসিত এক কুকুরকে পান করানোর ফলে তার সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে। অপর একজন মহিলা একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল। অতঃপর অনাহারে বিড়ালটি মারা যায়। এ অপরাধে মহিলাকে শাস্তি দেওয়া হয় এবং জাহান্নামি বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। সে বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল। অথচ তাকে আহারও করায়নি, পানও করায়নি। অপরপক্ষে তাকে ছেড়ে দেয়নি, যাতে সে জমিনের লতা-পাতা খেয়ে বাঁচত। একদিন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর নবী! চতুষ্পদ জন্তুর উপর দয়া করলে কি আমরা সাওয়াবের অধিকারী হবো? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। যে কোনো জীবের প্রতি দয়া করলে তোমরা তাতে সাওয়াবের অধিকারী হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
পশু-পাখি ও জীব-জন্তু আল্লাহর অনন্য দান এবং আমাদের উপকার ও সুবিধার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই জীব-জন্তু পশু-পাখিদের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি। তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদের অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৭০)
লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক, গবেষক