আকিজ মাহমুদ
প্রাণিজগতের সকল সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে বলা হয় সকল শ্রেষ্ঠতম এবং উন্নত বুদ্ধিসমৃদ্ধ প্রাণী। মানবজীবনের প্রাণের বিকাশের প্রারম্ভ থেকে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জীবকে মানুষ তার বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টির মধ্যে মানুষ যেন পেয়েছে স্বঘোষিত নেতৃত্ব। পৃথিবীর সমস্ত জীবের মধ্যে বাস্তুতান্ত্রিক যে শৃঙ্খলা বজায় আছে সেটি যদি কোনোক্রমে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে, তাহলে পুরো বিশ্বজগৎ ধ্বংসের চূড়ান্ত পর্যায়ে ধাবিত হবে। অর্থাৎ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই সব জীবের বিকাশ, বংশবৃদ্ধিতে আমাদেরকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে। কেননা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা গেলেই কেবল পৃথিবী হবে মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু আদতে আমরা কি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নিজেদের উজাড় করে দিতে পারছি? আমরা কি পারছি সকল জীবের বেঁচে থাকার জন্য অনুকূল পরিবেশ ও জলবায়ুকে স্থিতিশীল রাখতে? না। আমরা দেশ, জাতির তথাকথিত উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছি। এমতাবস্থায় জীবজগৎকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে আমাদের কথিত বিশ্বায়নের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছি।
বিভিন্ন বিজ্ঞানীর মতভেদে পৃথিবীতে জীবের সংখ্যা ২০ লাখ থেকে ১ লাখ কোটি পর্যন্ত হতে পারে। অনেকের মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত ৫০০ কোটির বেশি প্রজাতির জীবের আবির্ভাব হয়েছে এবং এদের শতকরা ৯৯ ভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে তাদের ধারণা। পৃথিবীর ইতিহাসে বিলুপ্ত প্রজাতির জীব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা যে মতবাদ দেন, তাতে বলা যায় সকল জীবের বিলুপ্তির পেছনে কেবল মানুষ দায়ী নয়। বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনকে জীবের বিলুপ্তির জন্য অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় শক্তিশালী ডাইনোসরের কথা। অধিকাংশ পরিবেশ বিজ্ঞানীর মতে, ডাইনোসরদের সময়ে মানব অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু আজকের দিনে চিত্র পাল্টে গেছে। সভ্যতা থেকে সভ্যতা মানব সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন এখন আকাশছোঁয়া। আকাশ-সমান নির্মিত ইমারত এখন সভ্যতার নিচ থেকেও চোখে মেলে না। কয়লাবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ কিংবা পারমাণবিক চুল্লি— কীসে নেই মানুষের উদ্ভাবনী! কিন্তু নির্মম সত্য, যেদিন থেকে মানবসম্প্রদায় নিজেদের উন্নতি নিয়ে ভাবা শুরু করেছে, সেদিন থেকেই এসব উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ জীবজগতের ক্ষতিসাধনে সিদ্ধ হয়েছে। একসময় জলবায়ুর সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা মানবসম্প্রদায় এখন নিজেরাই জলবায়ুকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
২০১৯ সালে রয়্যাল বোটানিক গার্ডেন এবং স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানান, বিগত ২৫০ বছরে ৫৭১টি উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। এই সময়ে পাখি, স্তন্যপায়ী আর উভচর মিলে বিলুপ্তির সংখ্যা ২১৭ প্রজাতি। অন্য একটি গবেষণায় জানা যায়, স্বাভাবিকের চাইতে উদ্ভিদের বিলুপ্তি হার পাঁচশগুণ বেড়েছে। আর জীবজগতের এই ভয়ঙ্কর রূপের জন্য গবেষক সরাসরি আঙুল তুলছেন জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের দিকে। বৈশ্বিক জলবায়ুর যে নিদারুণ অবস্থা, তারই ফল আমাদের চিরচেনা জীব প্রজাতিগুলোকে হারিয়ে ফেলা।
এখন প্রশ্ন এসে যায় জীববৈচিত্র্যের মাঝ থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রজাতির দরুন আমাদের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে? জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব আমরাই, মানবজাতি। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের জোগানদার আমাদের পারিপার্শ্বিক জীবজগৎ। জীবজগতের বিভিন্ন জীবের বিলুপ্তিতে স্বভাবতই ভেঙে যায় বাস্তুতন্ত্র এবং বিঘ্ন ঘটে খাদ্য শিকলের। পরিবেশ দূষণ রোধ করতে জীবমণ্ডলের সার্বিক সংরক্ষণ ও কার্যকারিতা বজায় রাখার কারণে জীববৈচিত্র্য আবশ্যক। পরিবেশে অক্সিজেনের সরবরাহ বজায় রাখতে, বৃষ্টিপাত ঘটাতে উদ্ভিদের ভূমিকা অপরিহার্য। এছাড়াও জীববৈচিত্র্য হলো প্রকৃতপক্ষে বিপুলসংখ্যক জিনের ভান্ডার। বিভিন্ন জীবের এই জিন ভান্ডার মানুষের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। বর্তমানে উন্নত গুণসম্পন্ন জিন জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভিদ ও প্রাণীতে স্থানান্তর করে উন্নত জাতের ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ ও প্রাণী তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। আর জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ করা না গেলে এসব জৈবপ্রযুক্তিতে জিন স্থানান্তর এবং পরিবেশ সুরক্ষা কোনোটাই সম্ভব হবে না। এছাড়াও ওষুধ, কাঠ, কাগজ, তন্তু, রাবার, আঠা, রজন, ট্যানিন, ফুলফল ইত্যাদি আমরা উদ্ভিদ থেকে পেয়ে থাকি, তেমনই বৈচিত্র্যময় প্রাণী প্রজাতি থেকে মাছ, মাংস, দুগ্ধসামগ্রী, চামড়া, পালক, উল, লাক্ষা, মধু ইত্যাদি সংগ্রহ করে আমরা আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করি। আবার বিভিন্ন জীবাণুর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমেও বিভিন্ন শিল্পসমগ্রী উৎপাদন করা যায়। অর্থাৎ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির প্রভাবে আমাদের জীবন-যাপনে অকল্পনীয় পরিবর্তন সাধিত হতে পারে এবং সেই পরিবেশে নিজেদের খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হলে আমাদের মানব সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি অতি আসন্ন।
সৌরজগতের ৮টি গ্রহকে কল্পনা করলে পৃথিবীর যে ভূত্বক, জলবায়ু এবং প্রাণ বিকাশের স্পন্দন লক্ষ করা যায় তা অন্য কোনো গ্রহে আজো আবিষ্কার হয়নি। কিন্তু মানুষের কর্মতৎপরতায় বিশাল জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) নামক আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশের ৩৯০টি বন্য প্রাণী কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন। একসময়ের নিত্য পরিচিত শকুন এখন আর দেখা যায় না, দেশে বরেন্দ্র এলাকায় হায়েনার দেখা মিলতো, উনিশ শতকেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় গণ্ডারের দেখা মিলতো। কিন্তু বর্তমানকালে এই অঞ্চলে প্রাণিগুলোর দর্শন কল্পনাও করা যায় না।
তাই আজকের এই দিনে আমাদের প্রত্যেককেই জীববৈচিত্র্য রক্ষার দৃঢ় শপথ নিতে হবে। পাশাপাশি বৈশ্বিক জলবায়ুর যে সংকট পৃথিবীব্যাপী দেখা দিয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব এবং পৃথিবীকে বাঁচাতে সব দেশ-জাতিকে একই মত, একই কাতারে দাঁড়িয়ে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় একযোগে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রত্যেক জীবের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার আছে। ১৯৮২ সালে জাতিসংঘের বিশ্বপ্রকৃতির ঘোষণাপত্রে এই চিন্তাধারা স্বীকৃতি পেয়েছে। এটিকে নীতিবাক্য মেনে নিয়ে সবাইকে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নিরলস কাজ করে যেতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়