আমি যখন বেড়ে উঠেছি, সেই সময়ের কথা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। আমাদের সময় বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের অভিভাবক ও সমাজের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ঠিক করত। মা-বাবা তার সন্তানকে কী বানাবেন বার বার বলে বলে ছোটবেলা থেকে সেটাই তার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতেন। স্কুলের শিক্ষকরাও মা-বাবার মনের কথা জেনে নিয়ে তার শিক্ষার্থীকে সেভাবে তৈরি করার চেষ্টা করতেন। আমরাও সে রকম প্রস্তুতি নিয়ে লেখাপড়া করতাম। স্কুলে শিক্ষক যখন ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লেখাতেন, তখন আমরা কে কী হতে চাই, কেন হতে চাই, সেসব বর্ণনা করে রচনা লিখে দিতাম। পরবর্তী-জীবনে মেধার জোরে কেউ মা-বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছি, কেউ পারিনি।
এখনো যে মা-বাবারা তাদের সন্তাদের তাদের ইচ্ছামতো বানাতে চান না, তা নয়। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরা আমার বেড়ে ওঠা সময়ের মতো নয়। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবাদের চিন্তাধারার বদলও ঘটেছে। শিক্ষকদের মানসিকতার মাঝেও পরিবর্তন এসেছে। পাড়া-প্রতিবেশী তথা সমাজের মানুষেরও চিন্তাভাবনা সেই আগের মতো নেই। এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে শেখানো হয়, আগে তুমি নিজেকে চেনো। তোমার আশপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশকে দেখো। সারাবিশ্বকে জানো। তুমি নিজেকে অন্যের মতো নয়, তোমার নিজের মতো করে গড়ে তোলো।
আমি নিজে একজন শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে আমার ছেলেমেয়েদের (ছাত্রছাত্রীদের) বলি, তুমি কী করতে চাও, কী অর্জন করতে চাও, তা নিজে নিজে ঠিক করো। তোমাকে দিয়ে মা-বাবা কিংবা তোমার আশেপাশের সমাজের মানুষ কী করাতে চায়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমাকে হতে হবে তোমার মতো।
আমিই কেবল এভাবে বলি না। বর্তমানের শিক্ষকসমাজ এখন তাদের শিক্ষার্থীদের এমন করে বলেন। কারণ বিজ্ঞানের অগ্রগতি আর প্রতিযোগিতার এই সময়ে কে কী বিষয়ে পড়বে, আর কে কখন কী পেশায় যাবে সেটা আগে থেকে কেউই ঠিক করে রাখতে পারে না। ডাক্তার হয়ে চিকিৎসা পেশায় না গিয়ে হয় প্রশাসক। প্রকৌশলী হয়ে দেখি পুলিশ বিভাগে চাকরি করতে। পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে হয় ব্যাংকার। তাই কে কী পেশা বেছে নেবে সেটা মুখ্য নয়। মুখ্য হলো নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলা।
আমি নিজে জীবনের বেশিরভাগ সময় নিজের মতো করে যাপন করিনি। আমাদের দাদি, নানি ও মায়েরাও যাপন করেননি। অনেকের মতো আমার ভুল ধারণা ছিল, আমি যেভাবে চাই, তেমনভাবে হয়তো চলা যায় না, অন্যদের মানিয়ে নিয়েই চলতে হয়। ধারণা ছিল এটাই সমাজের নিয়ম। অনেকেই যেভাবে বাঁচেন, সেভাবে হয়তো তারা বাঁচতে চান না। এই অনিচ্ছাকৃত বাঁচার প্রচেষ্টায় মানুষ পাওয়ার চেয়ে হারায় বেশি। আমিও হয়তো হারিয়েছি। মানুষ এখনো হয়তো হারাচ্ছে।
কিন্তু যখন আমার মতো আমি চলতে শুরু করলাম, দেখলাম খুব সহজ। অনেক দেরিতে হলেও আমার উপলব্ধি হয়েছে। এখন আমার মনে হয় এই ভূখণ্ডের নারীদের, তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব নিজেকেই নেওয়া উচিত। আমাকে আমার অনুভব ও অনুভূতিগুলো আমার মতো করেই লালন করতে হবে। আমি কীভাবে আমার আমিকে লালন করব, তা হবে সম্পূর্ণ আমার সিদ্ধান্ত। আমি আমার জীবনে আমার আমিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে ভয় পেতাম। ভাবতাম আমাকে অন্যদের খুশি করে, অন্যদের মন রক্ষা করে বাঁচতে হবে। সবসময় সমাজের রীতিনীতি মেনে চলতে হবে। মোদ্দাকথা, গ্রহণযোগ্যতার জন্য আমাকে অন্যদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। আর তাই তাদের কথা মেনে তাদের মতো চলার চেষ্টা করেছি।
অথচ আমার পূর্বসূরিরা অনেকেই আমার মতো ভাবেননি। লেখার কলেবর বেড়ে যাবে, তাই উদাহরণ দিতে গেলাম না। সেই পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থারকালেও তারা তাদের মতো করে চলে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সে জন্য অবশ্য তাদের অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। আর এখন তো সমাজ অনেক এগিয়েছে। তারপরও আর কেন? দেরিতে হলেও আমার বোধের উদয় হয়েছে। এই বোধোদয়ে আমি নিজেকে এক নতুন আমি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পেরেছি। এখন আমার উপলব্ধি থেকে আমি আমাকে বলি, অন্যকেও বলতে পারি; জীবন যখন আপনার, আপনাকে নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করতে হবে—আপনি কী চান? কীভাবে বাঁচতে চান? সর্বোপরি আপনার জীবন আপনি কীভাবে চালাতে চান?
অন্যরা কীভাবে কী করতে চায়, তা আপনার বিবেচ্য বিষয় নয়। আপনি অনন্য। আপনি শুধু আপনার মতো, সে শুধু তার মতো, আমি আমার মতো। আপনি যেমন সেভাবে আপনি গর্বিত হওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। আমি নিজেও আমার আমিত্ব নিয়ে গর্বিত। আমি আমার মতো থাকব, আপনি আপনার মতো। কেউ কারো সঙ্গে মানিয়ে নেবে উভয়ের প্রয়োজনে। মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব কখনো কারো একার পক্ষে সম্ভব না।
পৃথিবীতে অনেক কর্ম, অনেক পেশা, অনেক ব্যক্তিত্ব ও অনেক চরিত্রের মানুষ আছে। বিভিন্ন ধরনের মানুষ আছে বলেই পৃথিবীটা বৈচিত্র্যপূর্ণ। লাল বেগুনির মতো নয়, নীল হলুদের মতো নয়, এসব রং মিলেই রংধনু হয়। নিজের জীবন নিজের নকশায় সাজাতে হয়। জীবনটা নিজের ঘরের মতো, তাতে নিজের পছন্দের জিনিসগুলো জায়গা পায়। যে ফুল পছন্দের সেই ফুল ফুলদানিতে থাকবে। যে পোশাক পছন্দ সেগুলো ভালোবাসার আলমারিতে থাকবে। যে মানুষ পছন্দ সেই জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী হবে।
আপনার জীবন আপনার পছন্দ ও মূল্যবোধ অনুযায়ী চলবে। তবে নিজের মূল্যবোধ মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। মানুষ বিভিন্নভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। কেউ জোরে হাসে, কেউ হাততালি দেয়, কেউ নাচে। মানুষ দুঃখ প্রকাশ করে বিভিন্নভাবে। কেউ জোরে কাঁদে, কেউ নীরব গম্ভীর হয়ে যায়, আবার কেউ আড়াল হয়। যার যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ আসে, সেটাই সে প্রকাশ করবে।
আবেগ, অনুভূতি, সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা নিয়েই মানুষের সম্পূর্ণতা। মানুষ যন্ত্রচালিত হতে পারে না। সামাজিকভাবে বাঁচার জন্য অনুভূতিহীন রোবট হতে পারে না। যন্ত্রের মতো অনুকরণ করে বাঁচতে গেলে, মানুষের জীবনটাই বোঝা হয়ে ওঠে। নিজের কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে না। মানুষ নিজের মতো করে বাঁচতে না পারলে জীবনের স্বাদ পায় না।
নিজের জীবন যাপিত হতে হবে নিজের নির্দেশনায়, নিজের পরিচালনায়, নিজের প্রশাসনে। এতেই আত্মতুষ্টি এবং এতেই সুখ। কিন্তু নিজের মতো জীবনযাপন সবসময় সহজ নয়, তবে চলার স্বাধীনতা আছে। নিজের সুখের জন্য অন্য মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা কখনো মানবিক কাজ হতে পারে না। নিজের মতো চলতে হলে আত্মবিশ্বাস ও নিজের প্রতি আস্থা থাকতে হয়। না থাকলে তৈরি করতে হয়। তাতেই আসে সফলতা ও শান্তি।
লেখক : লতিফা নিলুফার পাপড়ি
শিক্ষক