পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার পর রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের সময়ও জীবন বাজি রেখে উদ্ধার তৎপরতা চালান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ওই ভবনে আটকে পড়া মানুষদের জীবন বাঁচানোই ছিল তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মনে হচ্ছিল ভবনে আটকা পড়ে বাঁচানোর আকুতি জানানো মানুষগুলো তাদের পরিবারেরই সদস্য। আগুনের ধোঁয়ায় যখন বেেঁচ থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে আসছিল সেই সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাঁধে-পিঠে করে আটকে পড়াদের বের করে আনেন এই আগুনযোদ্ধারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনায় অসংখ্য ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ছবি শেয়ার করে সবাই প্রশংসাসিক্ত করছেন তাদের।
গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ২১টি ইউনিট প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় সম্পূর্ণ আগুন নেভাতে সমর্থ হয়। পুলিশের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী এ ঘটনায় ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছেন আরো ৭০ জন।
অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবনটিতে আটকে পড়া শতাধিক নারী-পুরুষকে উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ওই ভবনের কয়েকটি তলা থেকে হাইড্রোলিক ল্যাডারের মাধ্যমে তাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। তাদের এই উদ্ধার তৎপরতার ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ভেসে বেড়াচ্ছে। ছবিগুলো দেখলে যে কারোরই চোখে জল আসবে। আটকে পড়া মানুষদের বাঁচাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সেই কী চেষ্টা! প্রতিটি আগুনযোদ্ধা প্রাণপণ লড়াই করেছেন যাতে কোনো প্রাণহানি না হয়। কিন্তু তাদের কাছে প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট থাকলে হয়তো এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বেশ কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। তার মধ্যে একটি ছবি হূদয় ছুঁয়ে যায়। সেটি ছিল এক তরুণীকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনার চিত্র। ছবিটাতে দেখা যায়, এক আগুনযোদ্ধার পিঠের ওপর ক্রন্দনরত এক তরুণী। তার সামনে-পেছনে আরো দুজন। ছবিতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ভয়ার্ত মুখে কাঁদছেন ওই তরুণী। তরুণীর ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়ে রয়েছে ছবিটাজুড়ে। তাকে টেনে নিয়ে আসছেন যে ব্যক্তি তার অভিব্যক্তিও হূদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে, শিহরিত করছে মানুষকে।
ভাইরাল হওয়া সেই ছবি নায়ক হলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) খন্দকার আবদুল জলিল। তিনি ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হলেও আগুনের ভয়াবহতা দেখে তাকে ছুটে যেতে হয় মানুষকে উদ্ধারে।
তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, টেলিভিশনে যখন দেখলাম আগুনের ভয়াবহতা এবং এখানে অনেক মানুষের জীবনের বিষয়... তখন আমরা মুভ করলাম ঘটনাস্থলের দিকে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা আগুন নেভানোর পাশাপাশি উদ্ধারকাজও চালিয়ে যাব।
আব্দুল জলিল বলেন, ঘটনাস্থলে তিনটি ল্যাডার ইউনিট দিয়ে আগুন নেভানো হচ্ছিল এবং আরেকটিতে আমি এবং আরেকজন ছিলাম। ওই ল্যাডার ইউনিট নিয়ে যখন ১২ বা ১৩ তলায় পৌঁছালাম তখন একটি মেয়ে বাঁচান বাঁচান বলে কাঁদছিল। আমরা তাকে কিছুটা আগাতে বলি তিনি জানান, সে হাঁটতে পারবে না, তার পায়ে আঘাত রয়েছে। সেই সঙ্গে ওই তরুণী ভয়েও ছিলেন। তিনি শুধু একটা কথাই বলছিল আমার মা নিচে আছে, মায়ের কাছে যাব।
এরপর ওই তরুণীকে নিজের কাঁধে তুলে নেন আব্দুল জলিল। এ সময় তিনি খুব কান্নাকাটি করছিলেন জানিয়ে আবদুল জলিল বলেন, ‘আমি তাকে হালকা করার জন্য জিজ্ঞাসা করি, কী করেন? তিনি জানান চাকরি করেন। এরপর তার বাবা-মায়ের নাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমার মা নিচেই আছে।’
আব্দুল জলিল বলেন, ‘মেয়েটি বাসায় চলে যেতে চাইলে আমি তাকে বলি প্রথমে হাসপাতালে যান, পরে বাসায় যাবেন।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবন রক্ষা করে আমরা তৃপ্তি পাই। এ ঘটনাও আমাকে তৃপ্ত করেছে। কিন্তু কেউ যদি মারা না যেত তাহলে আর কোনো অতৃপ্তি থাকত না।’
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা খুব দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসতে পেরেছিলেন। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট যদি থাকত তাহলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই এড়ানো যেত বলে মনে করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এফআর টাওয়ারের সপ্তম তলায় এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। পরে ছড়িয়ে পড়ে ২৩ তলা ভবনের বেশ কয়েকটি তলায়। প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা চেষ্টার পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও বিমানবাহিনীর পাঁচটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। ভবনটির ছাদে আটকে পড়া অনেককে উদ্ধার করে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার। এছাড়া অগ্নিনির্বাপণে হেলিকপ্টার থেকে ভবনটিতে পানিও ফেলা হয়।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদফতরে ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট ১২০ জন আহত হলেও তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে গেছেন। হাসপাতালে যারা আছেন তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যাজুয়ালটি বিভাগে ১, বার্ন ইউনিটে ৯, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১১, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৫, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৩, ইউনাইটেড হাসপাতালে ১৫, অ্যাপোলো হাসপাতালে ৬, শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫ ও লালমাটিয়া বিডি হাসপাতালে ১ জন চিকিৎসাধীন। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ২৫ জনের মধ্যে ইতোমধ্যে ২৪ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কান নাগরিকের লাশ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।