মুক্তমত

জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং করণীয়

  • প্রকাশিত ১১ জুলাই, ২০২১

গোলাম রাব্বি লিমন

 

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারনে জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী একটি চরম উদ্বেগজনক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি শীতপ্রধান ও তুষারপাতের দেশ কানাডায় অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং দাবানলের কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করেছেন। যদিও বিজ্ঞানীদের ধারণা গ্রিনহাউস প্রভাব পৃথিবীর কয়েকটি দেশে— কানাডা, রাশিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ আমেরিকা প্রভৃতি দেশগুলোর জন্য কিছু সাফল্য বয়ে আনতে পারে। কেননা ওইসব অঞ্চলে হাজার হাজার বছর ধরে বরফে আচ্ছাদিত লাখ লাখ একর জমি বরফমুক্ত হয়ে চাষাবাদ ও বসবাসযোগ্য হয়ে উঠবে। অন্যদিকে প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, অ্যান্টার্কটিকাসহ বরফসঞ্চিত পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের বফর আশঙ্কাজনক হারে গলা শুরু হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বরফ গলা এই বিশাল জলরাশি সমুদ্রে সঞ্চিত হতে শুরু করেছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমায়িত বরফ গলা শুরু করেছে ।

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার জিআইএসএস ইনস্টিটিউটের রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু ২০২০ সালেই বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ১৯৮০ সালের পর থেকে এই বৃদ্ধির হার বেড়েই চলেছে। অন্য এক সমীক্ষা অনুযায়ী একশ বছর আগের গড় তাপমাত্রার তুলনায় প্রায় ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, বৃদ্ধির এই গতি অব্যাহত থাকলে একুশ শতকের শেষের দিকে গড় তাপমাত্রা প্রায় অতিরিক্ত ২.৫ ডিগ্রি থেকে ৫.৫ সেলসিয়াস পর্যন্ত যুক্ত হতে পারে। উচ্চগতিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে পর্বতের উপরিভাগে জমে থাকা বরফ এবং মেরু অঞ্চলের সুপ্ত হিমবাহ দ্রুত গলা শুরু করবে। ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের এক বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের বরফে আচ্ছাদিত অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ থেকে প্রতি বছর ষোলো হাজার কোটি টন বরফ গলে যাচ্ছে। পূর্ববর্তী এক গবেষণায় বরফ গলার যে হার দেখা গিয়েছিল, তা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর এর ফলে বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ মিলিমিটার বেড়ে গেছে ।

জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বায়ু স্রোত মহাসাগরগুলো উষ্ণ পানিকে এই এলাকায় নিয়ে আসছে এবং তার সংস্পর্শে এসে এই হিমবাহগুলোর বরফ গলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে, অ্যান্টার্কটিকার ছয়টি হিমবাহতে যেভাবে বরফ গলে যাচ্ছে তা আর থামানো সম্ভব নয়। এই ছয়টি হিমবাহে যে পরিমাণ বরফ আছে তার সবই যদি গলে যায় তাহলে বিশ্বের সমুদ্রে পানির উচ্চতা প্রায় ১.২ মিটার বেড়ে যাবে, যার ফলে সাগরে তলিয়ে যেতে পারে পৃথিবীর অনেক অংশের নিচু জায়গা। জাতিসংঘের সতর্কতা অনুযায়ী, স্বাভাবিকভাবেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী ১৭ শতাংশ ভূমি পানির নিচে ডুবে যাবে। এতে আনুমানিক ৩ কোটি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি হারিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে ।

অপরদিকে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে একসময় মানুষের সহ্যসীমার অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং শীতপ্রধান ও তুষারপাতের অঞ্চলের মানুষের জন্য বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হবে। অর্থাৎ অতি নিম্ন তাপমাত্রায় অভ্যস্ত মানুষগুলো হঠাৎ করেই অতি উচ্চ তাপমাত্রায় মানানসই হবে না; ফলে প্রাণহানি ঘটবে। যেমনটি বর্তমানে কানাডায় প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর কিছু কিছু অঞ্চলে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হবে, অপরদিকে বেশ কিছু অঞ্চলে প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত হবে। ফলে সেসব অঞ্চলের বনাঞ্চলের গাছপালা পরিমিত আদ্রর্তার অভাবে শুস্ক হয়ে বৃদ্ধি ব্যাহত হবে এবং আশঙ্কাজনক হারে বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাবে ।

সবথেকে উদ্বেগজনক বিষয় হলো দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ থেকে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১৮০টি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের তথ্য নিয়ে তৈরি করা এক জরিপে দেখা গেছে, প্রাকৃতিক ক্ষতির দিকে থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম। গত ২০ বছরে দুর্যোগের সংখ্যা, মৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতির মোট হিসাব এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ রয়েছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার।

গ্রিনহাউসের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হেতু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্র জলরাশি বৃদ্ধি পেলে দেশের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে, সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ভূপৃষ্ঠে প্রবেশ করে নদীর প্রবাহ ব্যাহত করবে। বিশেষজ্ঞ তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের পর বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রবাহ নাটকীয়ভাবে কমে যাবে। এর কারণ হলো বঙ্গোপসাগরে জলরাশি বৃদ্ধি পাওয়া এবং ফুলে ওঠা জলরাশি ভূপৃষ্ঠে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। তাই নদীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সাগরে পতিত হওয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া রাজধানী শহর ঢাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১ মিটার উঁচুতে অবস্থান করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাজনিত কারণে ঢাকাও আক্রান্ত হতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে ২০০৯ সালে সুন্দরবনে সর্বপ্রথম সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অনুভূত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্যমতে, ২০০০ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত সমুদ্র প্রতি বছর ৩ মিলিমিটার বা ০.১২ ইঞ্চি করে বাড়ছিলো। কিন্তু পরবর্তী দশকেই প্রতি বছর ৫ মিলিমিটার বা ০.২০ ইঞ্চি করে বাড়া শুরু হয়েছে। সার্কের আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, হিরণ পয়েন্ট, চর চাঙ্গা এবং কক্সবাজারে জোয়ারের পানির স্তর প্রতি বছর যথাক্রমে ৪.০ মিলিমিটার, ৬.০ মিলিমিটার এবং ৭.৮ মিলিমিটার বেড়েছে। উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী বলা যায় যে, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পরতে শুরু করেছে। সুতরাং এই সমস্যার সমাধান পেতে এখনি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কোনো দেশের পক্ষে একা এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তবে প্রত্যেক দেশের নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধান করা উচিত। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমিয়ে আনতে হলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হওয়া কমাতে হবে। যেহেতু বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে।

এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বি উষ্ণায়ন থেকে মানুষের আবাসস্থল পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে সর্ব প্রথম কয়ালার ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে; নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে সমৃদ্ধ করতে বায়োটেকনোলজির ব্যবহার বাড়াতে হবে; কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে সোলার প্যানেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে; পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা ও বিস্ফোরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে; বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য শিল্প-কারখানাসমৃদ্ধ উচ্চ অর্থনীতির দেশগুলো বেশি দায়ী হলেও দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ নিধন ও কাঠ পোড়ানোর পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে; এবং পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত সর্ববৃহৎ বনাঞ্চল আমাজান মহাবন রক্ষায় অধিক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বিশ্ব নেতাদের। কেননা পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০ শতাংশ আসে এই বন থেকে ।

সর্বোপরি পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে জলবায়ু পরিবর্তন লক্ষ করা গেলেও সেই পরিবর্তন হয়েছে অনেক ধীরগতিতে এবং লাখ লাখ বছর লেগেছে। আর সেই পরিবর্তন হয়েছে কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে অর্থাৎ পৃথিবীর কক্ষপথ বা আবর্তনের গতি পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু গত কয়েক দশকের পরিবর্তন ঘটেছে অতি দ্রুতগতিতে এবং এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে পৃথিবীপৃষ্ঠে মানুষের পরিবেশবিরোধী কার্যকলাপ। সুতরাং এই পৃথিবী আমাদের এবং আমরা সবাইকে এই পৃথিবীকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads