জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বলছে, বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে প্রায় দুই কোটি শিশু জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে। দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোতে বসবাস করছে এক কোটি ৯০ লাখেরও বেশি শিশু। তারা ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের হুমকিতে রয়েছে। এই অবস্থায় শিশুরা বিভিন্ন ধরনের বিপজ্জনক কাজে যুক্ত হচ্ছে এবং পরিবারগুলো শহরমুখী হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ প্রকাশিত নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকির কথা প্রকাশ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবেলায় আরও বেশি করে উদ্যোগী হওয়ার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট সময় পর পর প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতায় বদলে যায় জলবায়ু। মানুষ সৃষ্ট কারণেই এই স্বাভাবিক বদলের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়েছে, বিশ্ব বহুদিন থেকে এক আকস্মিক পরিবর্তনের মুখোমুখি। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগে উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রাকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। উষ্ণায়নের কারণে গলছে হিমবাহের বরফ, উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্র, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক ঋতুচক্র। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, স্থানচ্যুত হচ্ছে মানুষ। অভিবাসী কিংবা শরণার্থীতে রূপান্তরিত হচ্ছে তারা। এরই মধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই সামনের কাতারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ১ কোটি ৯৪ লাখ শিশুর মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ শিশু নদী ভাঙনের এলাকা কিংবা এর কাছাকাছি থাকে। ৪৫ লাখ শিশুর বসবাস উপকূলীয় এলাকায়, সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের হুমকিতে থাকতে হয় তাদেরকে। তাছাড়া খরার ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ৩০ লাখ শিশু। এসব ঝুঁকির কারণে গ্রাম এলাকার মানুষেরা শহরের দিকে ধাবিত হতে বাধ্য হচ্ছে। আর সেখানে যাওয়ার পর নতুন ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে শিশুদেরকে। তাহলো জোরপূর্বক শ্রম কিংবা বাল্য বিয়ের ঝুঁকি। অভাবের তাড়নায় অনেককে শিশু শ্রমে লিপ্ত হচ্ছে। ভরণপোষণ চালাতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক মেয়ে শিশুকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে পরিবার।
ইউনিসেফের গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সিমন ইনগ্রাম। তার ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শহরগুলোতে প্রায় ৬০ লাখ জলবায়ু উদ্বাস্তু রয়েছে এবং এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তিনি বলেন, বন্যাজনিত বিপর্যয়গুলো চরম পর্যায়ের হয়ে থাকে এবং প্রায় প্রতি বছরই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় ধরনের বন্যা হয়েছিল ২০১৭ সালে। ওই বছর একের পর এক বন্যায় ৮০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইনগ্রাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে যে শুধু মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাই নয়, এর কারণে উপকূলীয় এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশের কারণে গর্ভবতী নারীরাও বড় ধরনের হুমকিতে রয়েছেন বলে সতর্ক করেছে ইউনিসেফ। এতে সেখানকার বিশুদ্ধ পানির সঙ্গে লবণাক্ত পানি মিশে যাচ্ছে এবং গর্ভবতী নারীরা প্রিএক্লেমশিয়া ও হাপারটেনশনসহ নানা ধরনের জটিলতায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
ইউনিসেফ বলছে, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য হুমকি থেকে দরিদ্রদেরকে বাঁচাতে এরই মধ্যে অনেক কিছু করেছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের হুমকিতে থাকা শিশুদের সুনির্দিষ্ট চাহিদার ওপর আরও গুরুত্ব দিতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ। বন্যাপ্রবণ এলাকার স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে আরও দায়িত্বশীল করে তোলা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের ওপর যেন কোনও শোষণ-নিপীড়ন না হয় তা নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংস্থাটির গবেষক ইনগ্রাম।