শ্রেণী পরিবর্তন করে নিজ স্ত্রীর কাছ থেকে সাফ কবলা দলিলে ২৪ শতক জমি রেজিস্ট্রি নিয়ে সোনাগাজী পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকনের বিরুদ্ধে অভিনব জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সরকার নির্ধারিত ৬ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে সাব-রেজিষ্টার ও তার অফিসের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মেয়রের জালিয়াতির এমন অভিনব কারসাজিকে সহয়তা করার অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার ভুমি নিবন্ধনের একমাত্র কার্যালয় মতিগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দীর্ঘদিন ধরে একটি জালিয়াতি চক্র জমির দাতা গ্রহিতা দলিল লিখক ও সাব রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজসে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করছে। এতে একদিকে সাধারণ মানুষ হয়রানীর শিকার হচ্ছে অন্যদিকে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
গত ১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাব-রেজিস্টার আমির হামজার স্বাক্ষরিত দলিল ৪৪১২/১৮ এর তথ্যে জানা যায়, সোনাগজী পৌরসভার তুলাতলী মৌজার ২৪ শতক নাল জমিকে শ্রেণী পরিবর্তন করে ডোবা দেখিয়ে বিক্রি করা হয়েছে। জমির ক্রেতা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন। আমোক্তারনামা দলিলে মেয়রের কাছে জমিটি বিক্রি করেন তার স্ত্রী তাসলিমা কাওছার।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের সুলাখালী গ্রামের নাজমুল হুদা চৌধুরীর মালিকানাধীন ৩৯৬ নং খতিয়ানভুক্ত পৌরসভার তুলাতুলি মৌজার ২৪ শতক নাল জমি তার স্ত্রী মিসেস রহিমা নুর চৌধুরীকে দানপত্র করেন। তিনি শ্রেণী পরিবর্তন না করে জমিটি নিজ নামে নামজারী করে ৮৮৯ নং খতিয়াতভুক্ত করেন। বিগত ২০ জুন ১৭ সালে উক্ত জমি রহিমা নুর চৌধুরী মতিগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসে ৩৩৫৭ নং দলিলে সোনাগাজী পৌর মেয়রের স্ত্রী তাসলিমা কাওছারের নিকট অফেরতযোগ্য আমোক্তারনামা দলিল মূলে হস্তান্তর করেন। পরে তাসলিমা কাওসার ৪৪১২/১৮ দলিলে ২৪ শতক নাল জমি সাফ কবলায় তার স্বামী পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকনের নিকট দশ লাখ ষাট হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করেন। দলিল রেজিস্ট্রি করার সময় শ্রেণী পরিবর্তন করে নাল জমিকে ডোবা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগ উঠেছে রফিকুল ইসলাম খোকন সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে এবং জ্ঞাত আয়বর্হিভুত সম্পত্তি অর্জনের তথ্য গোপন করতে অভিনব জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জমির শ্রেনী পরিবর্তন করেন। দলিলটির লেখক চরছান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন মিলন। তিনি আবার দলিলের সাক্ষীও হয়েছেন।
এ বিষয়ে চেয়ারম্যান মিলন জানায়, বিক্রেতোর সরবরাহকৃত তথ্যে আমি দলিল লিখেছি। বিক্রেতা যদি জমির শ্রেনীর প্রকৃত তথ্য গোপন করে থাকে আইননুযায়ী দায় দায়িত্ব তার। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে সত্যতা পেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারবে।
মতিগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসের তথ্য মতে হালনাগাদ সরকারী মূল্য তালিকা অনুযায়ী সোনাগাজী পৌরসভার তুলাতুলি মৌজার প্রতি শতক নাল জমির বিক্রয় মূল্য ৩ লাখ ৪২ হাজার পাঁচশত ষাট টাকা ও ডোবা জমির মূল্য ৪০ হাজার ৭ শত একাত্তর টাকা। সেই হিসেবে ২৪ শতক নাল জমির বিক্রয়মূল্য হবে ৮২ লাখ ২১ হাজার ৪শ ষোল টাকা। সরকারী নির্দেশনায় জমি রেজিস্ট্রি করতে বিক্রয় মূল্যোর সাড়ে সাত শতাংশ টাকা রাজস্ব হিসেবে জমা দিতে হয়। সেই হিসেবে নাল জমিকে ডোবা দেখিয়ে বিক্রয় মূল্য কমিয়ে রেজিস্ট্রি করে মেয়র খোকন সরকারের ৬ লাখ ১৬ হাজার ছয়শ আট টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে রাজস্ব ফাঁকির জালিয়াতির বিষয়টি যাতে ধরা না পড়ে তার জন্য মেয়র খোকন অভিনব জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। ডোবা শ্রেনী দেখিয়ে জমিটি রেজিস্ট্রি করার পর তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি) কার্যালয়ে গত ১৯ সালের ২৪ এপ্রিল ১১৮৫ নং খতিয়ানে ২৪ শতক জমি পুনরায় নাল হিসেবে নিজ নামে নামজারী করিয়ে নেন। অভিযোগ উঠেছে আর্থিক সুবিধা গ্রহন করে দলিলে জমিটির প্রকৃত শ্রেনী কি রয়েছে তাহা কোন প্রকার যাচাই বাচাই না করে উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি) নাসরিন আক্তার,পৌর ভুমি কর্মকর্তা মো: ইলিয়াছ,সার্ভেয়ার মিজানুর রহমান,কানুনগো টিনোদ বিহারি চাকমা মেয়র খোকনের অবৈধ কাজে সহযোগিতা করেন।
জমি বেচা কেনার সাথে জড়িত পৌরসভার তুলাতুলী গ্রামের একাধীক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মেয়র যে জমিটি কিনেছেন তার প্রকৃত বাজার মূল্য প্রতি শতক ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। আমরা যতটুকু জানি মেয়র প্রতি শতক জমি ৭ লাখ করে ক্রয় করেছেন। জমির প্রকৃত মালিক নাজমুল হুদা চৌধুরীকে মেয়র একটি বেসরকারী ব্যাংকের হিসেব নাম্বারে এককোটি টাকার চেকও দিয়েছে। মেয়র ও নাজমুল হুদা চৌধুরীর ব্যাংক হিসেব অনুসন্ধান করলে শতভাগ সত্যতা পাওয়া যাবে। প্রকৃত শ্রেনী দেখিয়ে জমিটি রেজিস্ট্রি করা হলে ক্রয়মুল্য দেখাতে হতো ৮২ লাখ টাকা। বিপুল এই টাকার বৈধ উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এই আশংকায় মেয়র ইচ্ছেকৃত জমির শ্রেনী পরিবর্তন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। তারা আরো বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়র খোকন বিপুল পরিমান জ্ঞাত আয় বর্হিভুত সম্পত্তির মালিক বনে যায়। গত নির্বাচনের সময় হলফনামায় প্রদত্ত সম্পত্তি বেড়ে তার বর্তমান সম্পত্তি কয়েকশ গুন বেশী হয়েছে। প্রায় ১শ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ২০ সালের ১ জানুয়ারী নোটিশ দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের সেগুনবাগিচার কার্যালয়ে খোকনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলেও প্রভাবশালী মহলের তবদিরে পরবর্তী তদন্ত থেমে যায় বলে দাবী করেন তারা।
অভিযুক্ত মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, শ্রেনী পরিবর্তনের মাধ্যমে জমি নিবন্ধন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটে থাকে তার জন্য আমি দায়ী না, দায়ী সাব-রেজিষ্টার কারন তিনি জমি রেজিস্ট্রি করেছেন। জ্ঞাত আয় বর্হিভুত বিপুল পরিমান সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবী করেন তিনি।
সহকারী কমিশনার(ভুমি) নাসরিন আক্তার বদলী হয়ে ভিন্ন কর্মস্থলে অবস্থান করায় অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমানে কর্মরত সহকারী কমিশনার জাকির হোসেন জানায়,তথ্য গোপন করে জমি নামজারী করা সঠিক কাজ হয়নি। তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেলে জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং বিবিধ ব্যবস্থার মাধ্যমে নামজারী বাতিল করা হবে।
অভিযুক্ত সাব-রেজিষ্টার আমির হামজা বদলিজনিত কারনে ভিন্ন কর্মস্থলে অবস্থায় করায় তার বক্তব্য জানা যায়নি। বর্তমানে কর্মরত সাব-রেজিস্ট্রার আকরাম হোসেন রিয়াদ বলেন, সাধারনত জমির ক্রেতা বিক্রেতা ও দলিল লেখক কাগজপত্র ঘষামাজা করে রাজস্ব ফাঁকি দিতে শ্রেনী পরিবর্তন করে থাকে। তদন্ত করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ প্রমানিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনার সাথে দলিল লেখকের সংশ্লিষ্টতা প্রমান হলে তার সনদ বাতিল করা হবে। আমার অফিসের কারো বিরুদ্ধে যদি এ ধরনের অপকর্মের সাথে সংশ্লিষ্টতার প্রমান পাওয়া যায় তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
জেলা রেজিস্টার আশ্রাফুজ্জামান বলেন, কেউ আইনের উর্দ্ধে না। জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সাথে সাব-রেজিস্টারসহ যে কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ মিলবে সবার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।