ডায়েরি, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র লেখালেখি আর বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি কবিতাও লিখেছেন তিনি। বোঝাই যায়, বিপ্লবী হওয়া সত্ত্বেও কবিতার মতো ভাবাবেগপ্রধান শিল্পের প্রতি তীব্র অনুরাগ ছিল তার, যদিও মনে করতেন, কবিতা লেখা হচ্ছে একেবারেই ‘পরম পবিত্র ব্যক্তিগত ব্যাপার’। শুধুই বিপ্লব নয়, বৈপ্লবিক রোমান্টিকতাও নয়, যদিও মনে করেছেন বিপ্লবীদের মধ্যে রোমান্টিক ভাবনাবীজ না থাকলে বিপ্লবীও হওয়া যায় না। সেই রোমান্টিকতা মানবমুক্তির লক্ষ্য অর্জনকে ঘিরেই আচ্ছন্ন করে রাখে একজন বিপ্লবীকে। তাহলে কি এই প্রশ্ন উঠতে পারে না যে, চে বিপ্লবী তো ছিলেনই, একইসঙ্গে ছিলেন কবিও?
চে’র জবানিতেই দেখছি, তিনি কিন্তু নিজেকে কবি বা লেখক মনে করতেন না। লেখক-বন্ধু আর্নেস্তো সাবাতোকে বলেছিলেন, সাহিত্য শুধু ‘ব্যক্তিক ব্যাপার’ নয়, একইসঙ্গে ‘সবচেয়ে পবিত্র’ একটা বিষয়। এভাবেই নিজে কতটা লেখক হয়ে উঠেছেন, বা আদৌ লেখক কি-না, নিজের অবস্থান তুলে ধরেছিলেন আমাদের কালের মানবমুক্তির মহান বিপ্লবী নেতা আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। কিন্তু লেখক-বুদ্ধিজীবীদের প্রতি তার ছিল প্রবল অনুরাগ। ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন তাদের। সম্ভবত এ কারণেই কিউবার বিপ্লবের পর সমকালের অনেক কবি-লেখকের সঙ্গে তিনি হয় ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেছিলেন অথবা চিঠিসহ নানা মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলেন। বহু লেখকের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তিনি যাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেইসব লেখক-বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ছিলেন জ্যঁ-পল সার্ত্রে, সিমোঁ দ্য বোভেয়ার, রেনে দেপেস্ত্রে লিয়ন ফেলিপের মতো লেখকরা। ফেলিপেকে লেখা একটা চিঠিতে তিনি নিজেকে ‘মহান বিষাদমগ্ন কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই ফেলিপেকে লেখা আরেকটা চিঠিতে নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমার দ্বারা কবিতা-টবিতা কিচ্ছু হয় না, আমি একজন ব্যর্থ কবি।’
কিন্তু কবিতা-বোদ্ধারা জানেন, দারুণ সব কবিতা লিখে গেছেন চে। ফেলিপে মনে করতেন, মানব সংগ্রামে কবিতার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। ফেলিপের ‘পুরুষ হরিণ’ নামের একটা কবিতা চে’র অনেক প্রিয় ছিল। ওই কবিতায় এক-একজন মানুষ কীভাবে ইতিহাসের নানান পর্বে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন আর নিগৃহীত হচ্ছেন তার কথা আছে। এই যে মানবিক সংগ্রাম, চে’র কাছে এটাই গুরুত্ব পেয়েছে। কী কবিতায়, কী বিপ্লবী আন্দোলনে বা সংগ্রামে।
চে তার প্রথম স্ত্রী পেরুর অর্থনীতিবিদ হিল্ডা গেদের (১৯২১-১৯৭৪) সঙ্গেও অনেক সময় কবিতা নিয়ে মেতে থাকতেন। তার পছন্দ ছিল রাডইয়ার্ড কিপলিঙের ‘যদি’ কবিতাটি। এই কবিতাতেও একজন বীরের কথা আছে। আসলে বীরত্বগাথা বলেই কবিতাটি চে’র প্রিয় ছিল।
আরেকজন কবিকেও অনেক পছন্দ করতেন চে। তিনি হচ্ছেন উরুগুয়ের নারীবাদী কবি হুয়ানা দে ইবারবরো। বলা প্রয়োজন, ইবারবরো কিন্তু বিপ্লবী কবি ছিলেন না, ছিলেন না আধুনিক কবিও। স্বয়ং চে তাকে সমকালের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ পোস্টমর্ডানিস্ট বা উত্তর-আধুনিক নারী-কবি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এই কথাটা ভাবতে এখন কেমন লাগে না? চে, যিনি ছিলেন মহান এক বিপ্লবী, তিনি উত্তর-আধুনিক একজন কবির কবিতা পছন্দ করতেন! চে’র মৃত্যুর পরে ইবারবরো ‘ডুমুর বৃক্ষ’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। সেই বইয়ের কবিতায় চে যে-গ্রামে জন্মেছিলেন, সেই গ্রামের কথা আছে। শুধু কি এই কারণে এই উত্তর-আধুনিক কবির কবিতা পছন্দ করতেন চে? আসলে তা নয়, চে কবিতাকে কবিতা হিসেবেই বিবেচনা করতেন। ভালো কবিতাকে তিনি ঠিকই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। যে কবিতা তার ভালো লাগত, সেই কবিতাকেই তিনি উল্লেখযোগ্য মনে করেছেন। কোন তাত্ত্বিকতার মোড়কে সেটা প্রকাশ পেল, সেটা কখনো বিবেচনায় আনেননি।
চে আর যাদের কবিতা ভালোবাসতেন সেই কবিদের মধ্যে তার পছন্দের শীর্ষে ছিলেন আরো দুজন কবি; প্রেমিক কবি বলে খ্যাত আর বিপ্লবের সমর্থক পাবলো নেরুদা ও নিকোলাস গিয়েন। তাদের কবিতা যে তিনি কেন পছন্দ করতেন, সেই পটভূমিটা এখানে বলা যেতে পারে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পরে চে’র দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন এলিয়েদা মার্চ। তিনি ছিলেন ক্যাস্ট্রোর কিউবান বিপ্লবী সেনাদলের একজন সক্রিয় বিপ্লবী যোদ্ধা। বলিভিয়া গিয়ে বিপ্লব করার প্রাক-মুহূর্তে চে এলিয়েদাকে তার কয়েকটা প্রিয় কবিতা আবৃত্তি করে রেকর্ড করতে বলেন। সেই কবিতাগুলোর মধ্যে ছিল নেরুদার ‘প্রেম ও বিষাদগীতির কুড়িটি প্রেমের কবিতা’র কবিতাগুলো। এর মধ্যে তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল ‘মনখারাপ করা গান’ শীর্ষক কবিতাটি। চে’র স্ত্রী এলিয়েদাও নেরুদার প্রেমের কবিতার দারুণ ভক্ত ছিলেন। নেরুদার ওই কবিতাটি শুরু হয়েছে এইভাবে : ‘আমার চারপাশে ঘিরে থাকা রাত্রির ভেতর থেকে উত্থিত হচ্ছে তোমার স্মৃতি...।’ পছন্দ ছিল নিকোলাস গিয়েনের এসপানিয়োল ভাষায় লেখা ‘মহৎ রক্তপাত’ আর ‘পিতামহ’। রুবেন মার্তিনেজ নামের আরো একজন কবির ‘ইনসমেনিয়ায় আক্রান্ত শিক্ষার্থী’ শীর্ষক কবিতাটি চে রেকর্ড করিয়েছিলেন। কবিতার প্রতি এরকমই গভীর অনুরাগ ছিল মহান বিপ্লবী চে গুয়েভারার, যার অনেক কথাই আমাদের জানা নেই।
এবার উরুগুয়ের নারীবাদী উত্তর-আধুনিক কবি হুয়ানা দে ইবারবরোর যে কবিতাটি চে’র প্রিয় ছিল সেই ‘ডুমুর বৃক্ষ’ কবিতাটি এখানে অনুবাদ করে দিচ্ছি :
কেন এটা এতটা নির্মম আর কুৎসিত
হয়ে পড়ল,
কেন এর সবগুলি শাখা-প্রশাখা এতটা ধূসর,
এই ডুমুর গাছের জন্যে আমার খুব দুঃখ হয়।
আমার তো আছে বৃক্ষঘেরা সুবিশাল বাড়ি :
এর চারদিকে কত যে বাদামের গাছ,
সোজাসুজি বেড়ে ওঠা লেবু গাছ,
কমলালেবুর ঝলমলে বৃক্ষরাজি।
বসন্তের সময় হলে
ওইসব গাছ ডুমুরের ফুলে ছেয়ে যায়।
শুধু যে-মানুষটি একা আর নিঃসঙ্গ
তারই শুধু মনখারাপ করে
যদি না ওর শাখাগুলিতে
ঝলমলে পোশাকের মতো
থোকায় থোকায় কুঁড়ি ধরে।
ফলে কী যে হয় আমার জানো,
ডুমুরের গাছগুলিকে
পেরিয়ে যেতে যেতে আমি বলি,
আমার কণ্ঠে দাও সেই সুমধুর আর
ঝঙ্কৃত সুর, আমি বলি :
‘আসলে বাগানের সব গাছের মধ্যে
সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে এই
ডুমুরের গাছগুলি।’
যদি ওই গাছেরা এসব কথা
শুনতে পেত
যে-ভাষায় আমি কথা বলি
তা যদি বুঝতে পারত,
এই গাছের সংবেদনশীল আত্মাটা
কী সুখী আর সুন্দরই না হতো!
আর হয়তো-বা রাত্রিবেলা,
যখন বাতাস ঝিরিঝিরি বইছে,
আনন্দ-মদিরায় আচ্ছন্ন হতে হতে
এ কথাই বলত :
দেখ, আজ মানুষেরা বলছে
আমরা কত-না সুন্দর!