নওগাঁর রাণীনগর উপজেলায় প্রথম বারের মতো চাষ করা হচ্ছে ইতালিয়ান জাতের সবজি চেরি টমেটো। বাগানে থোকায় থোকায় ঝুলছে চেরি টমেটো। বাড়ির পাশের জমিতে যত্ন করে গড়ে তোলা হয়েছে এ টমেটোর বাগান। রাণীনগর উপজেলার গোনা ইউনিয়নের বেতগাড়ী গ্রামের চাষি মাসুদ রানা খন্দকার তার ৫ শতক জমিতে বাগানটি গড়ে তুলেছেন। দেশে চেরি টমেটোর বেশ চাহিদা রয়েছে। তাই এর বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হলে আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ইউটিউব দেখে এবং স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শে গত বছরের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে একটি বীজ কোম্পানি থেকে ইতালির উন্নত জাতের চেরি টমেটোর ‘ম্যাগলিয়া রোসা’ জাতের বীজ সংগ্রহ করে নিজের জমিতে চেরি টমেটো চাষ শুরু করেন চাষি মাসুদ রানা খন্দকার। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় টমেটোর ফলনও হয়েছে বেশ ভালো।
চেরি টমেটো আকারে আঙুরের চেয়ে কিছুটা বড়। এই টমেটো কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও পাকলে তা গাঢ় লাল ও কমলা রং ধারণ করে। সাধারণত চার মাস পরপর ফলন পাওয়া যায়। প্রতিটি গাছ থেকে ৭ থেকে ৮ কেজি পর্যন্ত চেরি টমেটো সংগ্রহ করা যায়। মাসুদ রানার চেরি টমেটো চাষে সফলতা দেখে প্রতিদিন তার বাগানে ভিড় করছেন স্থানীয় চাষিরা। কৃষি অফিস থেকে সার্বিক সহায়তা ও পরামর্শ পেলে আগামীতে তারাও মাসুদের মত চেরি টমেটো চাষ করবেন বলে জানিয়েছেন।
স্থানীয় ভবানীপুর গ্রামের চাষি আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা মূলত ধান ও সবজি হিসেবে আলু, বেগুন, সীমসহ বিভিন্ন জাতের সবজির আবাদ করে থাকি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এই চেরি টমেটো আগে কখনো দেখিনি। এই প্রথম মাসুদ রানার বাগানে দেখলাম। আকারে আঙুর ফলের চেয়ে একটু বড়। দেখতে অনেক সুন্দর ও লাল টকটকে। মাসুদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, উৎপাদন খরচের চেয়ে লাভ অনেক বেশি। আর ফলনও নাকি বেশি হয়। যদি কৃষি অফিস থেকে আমাদের একটু পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হয় তাহলে আমরাও এই চেরি টমেটোর আবাদ করবো।
ঘোষগ্রামের গ্রামের চাষি আনোয়ার বলেন, বিভিন্ন সময়ে টিভিতে দেখেছি এই চেরি টমেটোর চাষ। তবে নিজ চোখে এই প্রথম দেখলাম। মাসুদের কাছে থেকে শুনে যতটুকু বুঝলাম তাতে মনে হলো অন্যান্য সবজি চাষের চেয়ে এই সবজি চাষ তুলনামূলক বেশি লাভজনক। মাসুদের ৫ শতক জমিতে ব্যাপক ফলন হয়েছে। রোগ বালাইও নাকি হয়নি। আর কীটনাশকমুক্ত সবজি চাষ করেছে। কি সুন্দর হয়ে প্রতিটি গাছের থোকায় থোকায় ঝুলে আছে চেরি টমেটোগুলো। খেয়েও দেখলাম অনেক সুস্বাদু। আমি এই সবজি চাষ করবো ভাবছি। তবে কৃষি অফিসের স্যারদের পরামর্শ চাই।
উপজেলায় এই প্রথম ইতালিয়ান জাতের চেরি টমেটো চাষি মাসুদ রানা খন্দকারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমি চার গ্রাম বীজ সংগ্রহ করে জমিতে রোপণ করেছিলাম। বর্তমানে আমার ৫ শতক জমিতে প্রায় ৪০০টির মতো চেরি টমেটোর গাছ আছে। এটি অতি উচ্চ ফলনশীল সবজি। দীর্ঘ সময় এর ফলন পাওয়া যায়। গাছে সহজে পচন ধরে না। বাজারে ব্যাপক চাহিদার কারণে চাষ করে লাভবান হওয়া সম্বব। আমি এই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চেরি টমেটো চাষ করেছি। আমার ৫ শতক জমিতে বীজ, পলি হাউস, মালচিং পেপার, সেচ, বিটামিন জাতীয় ওষুধ, শ্রমিক খরচসহ সব মিলে মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো। আশা করছি সব খরচ বাদ দিয়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মতো লাভ হবে। তবে সব মিলে কত মণ টমেটো হবে এটা সঠিকভাবে এখন বলা সম্ভব হচ্ছে না।
এই টমেটোর বাজার দরের বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, বর্তমানে রাজধানী ঢাকার সুপারশপগুলোতে আমদানি করা চেরি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকা কেজি দরে। তবে রাণীনগর উপজেলাসহ এই জেলায় চেরি টমেটোর বাজার নেই। কৃষি অফিসের সহায়তায় স্থানীয়ভাবে চেরি টমেটোর বাজার সৃষ্টি হলে আগামীতে আরো বেশি পরিমাণ জমিতে চাষ করতে চাই।
মাসুদ আরো বলেন, আমাদের এলাকার মাটি এই সবজি চাষের জন্য উপযোগী। প্রায় প্রতিদিনই আশপাশের অনেক গ্রাম থেকে চাষিরা আসছেন আমার এই বাগান দেখতে। তারা আমার কাছে থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। আবার অনেকে পরিকল্পনা করছেন এই সবজি চাষের জন্য।
রাণীনগর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আহসান হাবিব রতন বলেন, বেলে মাটিতে শীতকালে চেরি টমেটোর চাষ করা হলে চাষিরা লাভবান হতে পারবেন। উপজেলায় এই প্রথম পরীক্ষামূলক চেরি টমেটোর চাষ করে মাসুদ রানা খন্দকার সফল হয়েছেন। আর ১৫-২০ দিনের মধ্যে জমি থেকে বিক্রির জন্য চেরি টমেটো উঠানো যাবে। পলিশেড, নেট হাউস দেওয়ার কারণে ভেতরে পোকা-মাকড় প্রবেশ করতে পারে না। যার কারণে কীটনাশকমুক্ত চেরি টমেটো চাষ হচ্ছে। চেরি টমেটো চাষাবাদে কৃষি অফিস থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে বাজার সৃষ্টি করতে কৃষি অফিস থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
আহসান হাবিব বলেন, যেসব চাষিরা চেরি টমেটো চাষ করতে আগ্রহী আমরা তাদের সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দিব। ইতোমধ্যে আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে এই সবজি চাষের জন্য চাষি ভাইদের উদ্বুদ্ধ করতে উঠান বৈঠক শুরু করে দিয়েছি। সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর হওয়ায় বাজারে এর চাহিদাও অনেক। বর্তমানে চেরি টমেটো বিভিন্ন সুপার সপে কেজি প্রতি ৫০০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অল্প খরচে বেশি লাভ হওয়ায় এই টমেটোর চাষে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হবেন বলে আশা করছি। উৎপাদন বেশি এবং বাজারে চাহিদা থাকায় কৃষকরা অনেক লাভবান হতে পারবেন বলে মনে করছেন এই কৃষি কর্মকর্তা।