জাফরুল ইসলাম
বাংলাদেশের সংবিধানে যে ৬টি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম এক মৌলিক অধিকারের নাম চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার। যন্ত্র বা মেশিন যখন অকার্যকর হয় তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মেকারের কাছে। কারণ একমাত্র মেকার বা ওই বিষয়ে এক্সপার্ট ব্যক্তি সেটি ঠিক করে দিতে পারে। ঠিক তেমনি একজন মানুষ যখন অসুখে ভোগে, তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসকের কাছে। কারণ একজন চিকিৎসকই পারে তার মেধাা মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ করে দিতে। আগের দিনে যখন কোন মানুষ অসুস্থ হতো, তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হতো গ্রাম্য হেকিম কিংবা কবিরাজের কাছে। এসব কবিরাজ তাবিজ, ফুঁ দিয়ে মানুষের চিকিৎসা করতেন। যার ফলে এমনও দেখা গেছে যে, মানুষরা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়েছে। এরপর চিকিৎসা জগতে এলো এক নতুন পদ্ধতি যার নাম হোমিওপ্যাথি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে লাগল চিকিৎসকরা। কিন্তু বর্তমানে এই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকে ছাড়িয়ে বিজ্ঞানের বদৌলতে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছে, যার নাম অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা।
এই চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভবের পর থেকে চিকিৎসা সেবা যেন নতুন এক মাত্রা পেল। এখন আর ভুল চিকিৎসা এবং চিকিৎসার অভাবে মানুষের মৃত্যু খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ বর্তমানে যে কোন অসুখেই হাতের কাছে এমবিবিএস ডাক্তার পাওয়া যায়। আবার অন্যদিকে জেলা শহরে রয়েছে সরকারি হাসপাতাল। যে হাসপাতালগুলোতে নামমাত্র মূল্যের বিনিময়ে উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। এই সুযোগ-সুবিধার কারণে আজ অতি দরিদ্র মানুষ আধুনিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারছে। যে কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা অতি দ্রুত এবং অতি কম খরচে হচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কি চিকিৎসাসেবা খুব সহজে এবং সহজ মূল্যে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করতে পারছে?
বাংলাদেশে দুই ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু রয়েছে— এক. সরকারি হাসপাতাল; এবং দুই. বেসরকারি বা প্রাইভেট ক্লিনিক। যারা ধনী বা তথাকথিত উচ্চবিত্তশালী। তারা উন্নত মানের চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করার জন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে। অন্যদিকে যারা নিম্ন এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত, অতিদরিদ্র তারা সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে। কিন্তু যখন আমরা সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা গ্রহণ করতে যাই, তখন দেখি সেখানে নানারকম অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ভরপুর। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এক শ্রেণির দালাল থাকে। যারা অর্থের বিনিময়ে ভালো চিকিৎসাসেবা প্রদান করা অঙ্গীকার করে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়। আবার দেখা যায় ডাক্তাররা যদি কোনো টেস্ট করতে বলেন, তখন হাসপাতালগুলোতে উক্ত টেস্ট না করিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বেসরকারি কেন্দ্রগুলোতে, যেখানে গুনতে হয় বাড়তি অর্থ। কারণ হাসপাতালগুলোতে যে টেস্ট করা হয় সেগুলোর মাধ্যমে ভালোভাবে রোগ শনাক্ত করা যায় না। কেননা এসব মেশিনগুলো অকার্যকর এবং অনুন্নত।
উপরন্তু ডাক্তারকে দেখানোর পর ব্যবস্থাপত্রের ওষুধগুলো হাসপাতালগুলোতে পাওয়া যায় না। হাসপাতালগুলোতে শুধু পাওয়া যায় নাপা, প্যারাসিটামল জাতীয় ওসুধ। অন্যদিকে রোগীর সঙ্গে ডাক্তারের দুর্ব্যবহার নিত্যদিনের ঘটনা। এমনও দেখা যায় ডাক্তার রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বদলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে রুম থেকে বের করে দেয়। অন্যদিকে হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে নার্স পর্যন্ত সবাই যেন এক একজন রাজা। হাসপাতালটা তাদের রাজ্য, এবং সাধারণ জনগণ তাদের রাজ্যের প্রজা। তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে অন্যরকম এক ব্যবহার করে যা মোটেই কাম্য নয়। কারণ তারা হলো জনগণের সেবক। জনগণের টাকায় তাদের বেতন প্রদান করা হয়। তারা কর্মকর্তা নয় বরং কর্মচারী।
আজ হাসপাতালগুলোর এমন চিত্রের ফলে সাধারণ জনগণ সরকারি হাসপাতালগুলোর ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছে। চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করার জন্য তাই তো তারা ছুটে চলছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। যেখানে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার বিনিময়ে অভিজ্ঞ ডাক্তারকে পাওয়া যাচ্ছে। এবং নিজের সমস্যার কথাগুলো খুব সহজ এবং সুন্দর করে বলা যায়। আর ডাক্তারও তার কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে সঠিক ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে থাকে। অথচ এখানেও অথূই কথা বলছে। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এমন ঘটনা নিত্যদিন ঘটে, হাসপাতালগুলোতে ব্যবসা হয় রোগীদের নিয়ে। কে কত টাকা হাতিয়ে নিতে পারে তার এক চরম প্রতিযোগিতা চলছে সেখানে। অথচ জনগণের টাকায় চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা হয়। ডাক্তার থেকে শুরু করে চিকিৎসার সংশ্লিষ্ট সবাইকে বেতন দেওয়া হয় জনগণের টাকায়। আবার সেই জনগণ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে ব্যবসায়ী পণ্যে পরিণত হয়।
হায়রে দুর্ভাগা দেশ! আসলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এমন অবস্থা হওয়ার কারণ হলো তদারকির অভাব। সরকার যদি এখানে বিশেষ তদারকির ব্যবস্থা করতো তাহলে কেউ দুর্নীতি করার সাহস পেত না। কারণ শাস্তি থেকে সবাই ভয় করে। তাই সরকারের কাছে আকুল আবেদন অতিসত্বর এর একটা সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার তার চিকিৎসাসেবা সুগম ও সুলভ করার উদ্যোগ নিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়