রতন বালো
গণপরিবহনে ভাড়া নির্ধারণে সরকারি প্রজ্ঞাপন মানছেন না বাস মালিকরা। গত বছর ৭ নভেম্বর রাজধানীসহ চট্টগ্রাম মহানগরীতে গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ৮ নভেম্বর থেকে কার্যকর করার কথা থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি। কোনো কোনো বাসে শিক্ষার্থীদেরও অর্ধেক ভাড়া নিতে চায় না।
বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিদিন কন্ডাক্টর ও হেলপারদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। এমনকি হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটছে। আবার কোনো যাত্রী বেশি ভাড়া নেওয়ার প্রতিবাদ করলে তাকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে গণপরিবহনের চালক ও হেলপাররা।
ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে গত বছর ৭ নভেম্বর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিভিন্ন রুটের বাসে ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়। মিনিবাসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ০৫ পয়সা। বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকার জায়গায় ১০ টাকা এবং মিনিবাসে ৫ টাকার জায়গায় ৮ টাকা নির্ধারণ করার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যা গত বছর ৮ নভেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। কিন্তু চার মাসেও সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় করছে না বাস মালিক ও শ্রমিকরা।
তবে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার দায়ে ২৫টি বাস কোম্পানির পারমিট বাতিলের সুপারিশ করেছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। একই অপরাধ করায় এসব বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে রুট পারমিট বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি (আরটিসি)’র কাছে পাঠানো হয়েছে বলে গত ৯ ডিসেম্বর বিআরটিএ’র এ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও ওইসব বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি বিআরটিএ।
এদিকে বিআরটিএ’র এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে বাসের সর্বনিম্ন ১০ টাকার ভাড়া নেওয়া হয় ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা। আবার ৮ টাকার ভাড়া ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা। কোন গণপরিবহনেও সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ভাড়া নেওয়া হয় না। রাজধানীতে রাইদা, তুরাগ, ভিক্টর পরিবহন, ৮ নম্বর, মক্কা-মদিনাসহ বিভিন্ন গণপরিবহনে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট কোনো যাত্রী দেখতে চাইলে, তা দেখাতে পারেন না এসব গণপরিবহন।
এ বিষয়ে জানার জন্য বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো কথা না বলে তার পিএ রায়হানুল আলম (পরিচালক, ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশ শেখর বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। কিন্তু তিনিও কথা বলতে চান না।
বিআরটিএ’র পরিচালক (প্রশাসন) মো. আজিজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কথা বলেননি। তার পিএ মো. রেজাউল বলেন, পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব ই-রব্বানীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। কিন্তু তাকেও পাওয়া যায়নি। এই হচ্ছে বিআরটিএ’র কর্মকর্তাদের চিত্র। এ কারণেই গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি রোধ করা যাচ্ছে না।
বিআরটিএ’র কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে বাস মালিকরা ইচ্ছেমতো ভাড়া বাস পরিচালনা করছেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী থেকে গাবতলী পর্যন্ত সড়ক পথের দূরত্ব ১৭ কিলোমিটারের একটু বেশি। প্রতি কিলোমিটার ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসেবে এই পথের বাস ভাড়া হয় ৩৬ টাকা। কিন্তু মৌমিতা নামের একটি পরিবহন যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেয় ৫০ টাকা।
এদিকে এই বাসটি কাঁচপুর থেকে সাভার রুটে চলাচল করে। সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা হলেও এই পরিবহনে নেওয়া হয় ২০ টাকা। কেউ ১ কিলোমিটারের কম পথ অতিক্রম করলেই তার কাছ থেকেও ২০ টাকা ভাড়া আদায় করা হয় বলে যাত্রীরা অভিযোগ করেন।
আয়নাল, জয়নাল, আজম ও রাজিব নামের গুলিস্তানের চার যাত্রী বলেন, এই বাসে উঠলেই ২০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। গাড়িতে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার কোনো চার্ট নাই। তারা সরকারি চার্ট মানতে চাচ্ছে না। ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করে। যাত্রীরা প্রতিবাদও করে না। কারণ প্রতিবাদ করলেই নামিয়ে দেওয়া হয়। নইলে যাত্রীদের গায়ে হাত তুলে চালক, কন্ডাক্টর, হেলপারগণ।
মো. মিজান, মো. শাউন, মো. শওকত নামের কয়েকজন ছাত্র বলেন, এই বাসের স্টাফরা খুব খারাপ। শিক্ষার্থীদেরও অর্ধেক ভাড়া নিতে চায় না। বলে শুক্রবার স্কুল-কলেজ বন্ধ। তাই কোন হাফ পাস নেই। অন্য সময় অর্ধেক ভাড়া নেয় না। ২০ টাকার ভাড়া নেয় ১৫ টাকা করে। বলে এটা হাফ ভাড়া। গেলে যান না হলে নেমে যান।’
এভাবে প্রতিদিন রাজধানীর বিভিন্ন রুটে ভাড়া নিয়ে যাত্রী ও বাস স্টাফদের বিতর্ক চলে। কোন কোন সময় তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে গত বছর ৭ নভেম্বর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিভিন্ন রুটের বাসে ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সার থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়। মিনিবাসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ০৫ পয়সা। বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকার জায়গায় ১০ টাকা এবং মিনিবাসে ৫ টাকার জায়গায় ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা গত বছর ৮ নভেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। কিন্তু সাড়ে তিন মাসেও সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় করছে না বাস মালিক ও শ্রমিকরা।
সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায়ের নিয়ম মানে না কেউ। বিআরটিএ’র কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। রাজধানীতে চলাচলরত লেগুনা, বাস, মিনিবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ সব গণপরিবহনে ভাড়া আদায় করা হয় ইচ্ছেমতো।
যাত্রাবাড়ী-গাবতলী রুটে চলাচলকারী ২১ নাম্বার বাস (সাবেক ৮ নাম্বার) বর্তমানে যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট ভাড়া নেওয়া ২০ টাকা। তবে যাত্রাবাড়ী-মিরপুর রুটে চলাচলকারী শিকড় পরিবহন নেয় ৩০ টাকা। একইভাবে যাত্রাবাড়ী থেকে মতিঝিল, পুরানা পল্টন, গুলিস্তানের ভাড়া সাধারণত ৮ টাকা। কিন্তু ট্রান্স সিলভা পরিবহন নেয় ১০ টাকা, শিকড় পরিবহন নেয় ১০ টাকা, গ্রামীণ বাংলা পরিবহন নেয় ২০ টাকা।
রাজধানীর মিরপুরের টেকনিক্যাল মোড় থেকে সায়েন্স ল্যাব পর্যন্ত বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া যাত্রীপ্রতি ১৩ টাকা। মিরপুর ও সাভার থেকে আসা বাসগুলো টেকনিক্যাল মোড় থেকে যাত্রী তোলে। দিশারি, বাহন, ট্রান্স সিলভা, সাভার ও মৌমিতা পরিবহনে এই দূরত্বের ভাড়া নেওয়া হয় ২০ টাকা। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ৫ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি আদায় করা হয় ওইসব বাসে।