দিন দিন মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে প্রকৃতির ওপর। নিয়ন্ত্রণের নামে চালিয়ে যাওয়া এই নিষ্ঠুরতা রীতিমতো মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও সেদিকে খেয়াল নেই মানুষের। কয়েক হাজার বছর আগে নগর সভ্যতার বিকাশের পর থেকে মানুষ আর প্রকৃতির মধ্য বাড়তে শুরু করে দূরত্ব। তবে শিল্পবিপ্লবের পরে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করতে শুরু করে। শতকের শেষার্ধে এসে সেই নিষ্ঠুরতার মাত্রা যে ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছায় তা অব্যাহত আছে আজো। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) সম্প্রতি সেই ভয়াবহ অত্যাচারের একটি চিত্র তুলে ধরেছে। ‘লিভিং প্লানেট রিপোর্ট-২০১৮’ নামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে পৃথিবীর বন্যপ্রাণীদের ৬০ শতাংশ মানুষের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রভাবে প্রাণ হারিয়েছে। বিলুপ্ত হয়েছে হাজার হাজার প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, মাছ, সরীসৃপ ও উভচর প্রাণী।
পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য নিয়ে দুই বছর পরপর এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ডব্লিউডব্লিউএফ। তবে আগের সব প্রতিবেদনের তুলনায় এ বছরের প্রতিবেদনে বন্যপ্রাণীর প্রতি অত্যাচারের সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ১৯৭০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বনাঞ্চল অ্যামাজনের ২০ শতাংশ ধ্বংস করা হয়েছে। আর ২০০০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে কলকারখানা ও বাসস্থানের জন্য সারা বিশ্বের ৯২ মিলিয়ন হেক্টর বন উজাড় করেছে মানুষ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত স্থলভাগের ৭৫ শতাংশ প্রজাতির প্রাণী কৃষির কারণে বিলুপ্ত হয়েছে। প্রায় তিন কোটি বছর ধরে সমুদ্রের অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও গত ৩০ বছরে উপকূলীয় এলাকার ৫০ শতাংশ প্রবাল বিলুপ্ত হয়েছে মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে।
প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে, পুরো পৃথিবীর মাত্র ২৫ শতাংশ এখন মানুষের কর্মকাণ্ডের বাইরে আছে। তবে ২০৫০ সাল নাগাদ এই পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশে নেমে আসবে।
প্রায় ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের আলোকে তৈরি করা চলতি বছরের ‘লিভিং প্লানেট রিপোর্ট’ বলছে, সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে জন্ম এই পৃথিবীতে পালাক্রমে এসেছে নানা জাতের প্রাণী। সৌরজগতের এই গ্রহটিতে সরল প্রাণীকোষের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে। ৪০ কোটি বছর আগে আসে কীটপতঙ্গ, ৩০ কোটি বছর আগে ডাইনোসর এবং ১৩ কোটি বছর আগে সম্পূরক উদ্ভিদ। এর মধ্যে ডাইনোসর কয়েক কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে প্রবল বিক্রমে। তারপর এক সময় বিলুপ্তও হয়ে গেছে একেবারে। এই বিলুপ্তির পেছনে যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাজ করেছে, তেমনি নিজেদের প্রবল ক্ষমতাও ডাইনোসরের বিলুপ্তির অন্যতম একটি কারণ। সে তার চারপাশের কোনো প্রাণীকেই পাত্তা দেয়নি। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ইচ্ছামতো হত্যা করেছে। তারপর একসময় ভুগেছে খাদ্য সঙ্কটেও। ডাইনোসরের বিলুপ্তির পরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম মেনে অনেক প্রাণী বিবর্তিত হয়েছে বা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায়ই পৃথিবীতে আদিম মানুষের আগমন ঘটে প্রায় ২০ লাখ বছর আগে। আর আধুনিক মানুষের বসবাসের ইতিহাস মাত্র দুই লাখ বছরের। তবে এ সময়ের মধ্যেই নিজেদের মেধা আর কৌশল দিয়ে প্রকৃতির ওপর যেভাবে শোষণ শুরু করেছে, তাতে করে ডাইনোসরের মতোই হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে মানুষও। প্রকৃতির প্রতি দরদ আর দায়বদ্ধতা না বাড়ালে কথিত এই মানব সভ্যতার সূর্য ডোবার খুব বেশি সময়ও বাকি নেই।
এর মধ্যেও একটি আশার কথা শুনিয়েছেন ডব্লিউডব্লিউএফের মহাপরিচালক মার্কো ল্যাম্বারটিনি। তিনি বলেছেন, আমাদের হাতে এখনো সময় আছে। এখনই বিশ্বজুড়ে এই ইস্যুতে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বন্ধ করতে হবে অযাচিত হারে প্রকৃতি ধ্বংসের পায়তারা।