করোনাকাল তরুণদের জীবনে মহাসংকট বয়ে নিয়ে এসেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত বছরের মার্চ মাসের শেষ থেকে বন্ধ। শিক্ষার ক্ষতি ও সেশনজট কমাতে সাময়িক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বটে; তবে বাস্তবতা এটাই যে, লাখ লাখ বেকার তরুণের চাকরির বয়স চলে গেছে এবং প্রতিদিনই শত শত বেকার তরুণের চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাতে অধ্যয়নরতদেরও বয়স বাড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সেশনজট তৈরি হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। করোনাকালে চাকরির বিজ্ঞপ্তি কমে গেছে। আবার চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা সময়মতো হচ্ছে না। ফলে স্বাভাবিকভাবে চাকরিতে যোগদানের বয়স বাড়ার দীর্ঘদিনের দাবি করোনাকালে আরো জোরালো হয়েছে।
বাড়ছে বেকারত্ব। যদিও আমাদের দেশে বেকারদের জন্য বেকার ভাতা চালু নেই। বেকারত্বের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় বেকার তরুণের আত্মহত্যার খবরও শোনা যাচ্ছে! যোগ্যতা অনুযায়ী সময়মতো তরুণদের কর্মসংস্থান না হওয়ায় হাজার হাজার বেকার তরুণের স্বপ্ন ও তাদের পরিবারের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে হারে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা তাও বছর শেষে হচ্ছে না। করোনাকালে চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। করোনার এই ভয়াবহ দুর্যোগের পরিসমাপ্তি কবে ঘটবে তাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে লক্ষ লক্ষ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স শেষ হওয়া ও অধ্যয়নরতদের সম্ভাব্য সেশনজটের কথা চিন্তা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো সময়ের দাবি। শুধু করোনাকালের এ সময়ে নয়, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবিটি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সংসদের ভেতর-বাহিরও ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। চাকরির বয়স নিয়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর জোর আন্দোলনের মুখে কোনো কোনো সময় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল।
বর্তমানে সাধারণের জন্য চাকরিতে যোগদানের বয়স ৩০ এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩২। এখন সময় হয়েছে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো। তাই চাকরিতে যোগদানের বয়স সাধারণের ৩৪, নারী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ৩৫ করা সময়ের দাবি। এভাবে বয়স বাড়ানো হলে সাধারণের থেকে আগের মতো মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরাও এক বছর বেশি সময় পাবে। আবার কর্মক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে নিতে তারাও এক বছর বেশি সময় পাবে। সার্বিকভাবে সাধারণের বয়স বাড়ার পাশাপাশি সবারই লাভ হবে। মুজিববর্ষে তরুণদের জন্য করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এর থেকে ভালো সমাধান আর হতে পারে না। চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯১ সালে। এরপর কুড়িটি বছর অতিক্রান্ত হলো। সময়ের ব্যবধানে দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক পালাবদল ঘটল। যার ঢেউ এসে মানবজীবনেও পড়ল। গড় আয়ুও এখন বেড়ে ৭২ বছর। এছাড়া মানুষের জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত প্রায় সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সবকিছুতেই ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। কখনোসখনো বিভাগীয় প্রার্থী বা বিশেষভাবে কিছু কিছু চাকরিতে ৩০-এর পরেও চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বাড়ানো হয়নি।
ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বছরের পর বছর শুধু বেড়েই চলেছে। বিনিয়োগ না বাড়ায় কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সর্বশেষ গবেষণা বলছে, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বর্তমানে শিক্ষিত বেকার ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রত্যেক বছর গেল বছরের চেয়ে আরো বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্র ও পদসংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাকরি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ১৬০টিরও অধিক দেশে এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এর অধিক। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও চাকরির বয়স ৩০-এর ওপরে। বাস্তবতা এটাই যে, এদেশে বর্তমানে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে কিন্তু চাকরি নেই! উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশে উচ্চ শিক্ষিত তরুণ বেকারদের কর্মসংস্থান হওয়ার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র ‘বেকার ভাতা’ দিয়ে থাকে। ভালো হতো যদি করোনাকালের এ বছরের বাজেটে সরকার বেকার ভাতার কোনো ঘোষণা দিত। কিন্তু তা হয়নি। করোনাকালে টিউশনি করে বেকার তরুণদের টুকটাক আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে নিজের পরিবারের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে লোকলজ্জা ভুলে পথে নেমেছেন।
বেকার তরুণরা এ রাষ্ট্রের সম্পদ। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাষ্ট্র লক্ষ লক্ষ টাকা ভর্তুকি দিয়ে তরুণ শিক্ষার্থীদের দেশ গড়ার কাজে গড়ে তোলে। বেকার তরুণরা যদি কর্মসংস্থানসহ নানা কারণে হতাশায় ভোগে সেটা রাজ্যের জন্য লজ্জার। তাই করোনাকালে উচ্চশিক্ষিত বেকার তরুণদের জন্য বেকার ভাতা চালু করা দরকার। করোনাকালে বেকার ভাতার দাবি আরো জোরালো হয়েছে। বয়সে সাময়িক ছাড় নয়, দরকার চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো। দরকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্ভাব্য সেশনজটের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া। করোনাকালে লক্ষ লক্ষ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স বিবেচনা ও দীর্ঘদিনের ন্যায্য দাবির প্রেক্ষাপটে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়স যৌক্তিকভাবে বাড়ানো অত্যাবশ্যক। সুতরাং চাকরিতে যোগদানের বয়স সাধারণের ৩৪, নারী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ৩৫ করা হোক। কর্মসংস্থানহীন করোনাকালের পরিবর্তিত বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে মুজিববর্ষে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর ঘোষণা হবে তরুণদের জন্য সেরা উপহার।
লেখক : পরিবেশকর্মী ও মুক্তগদ্য লেখক
sadonsarker2005@gmail.com