মতামত

একাত্তরের গণহত্যা

চাই বিশ্বজনীন স্বীকৃতি

  • আ. ব. ম. রবিউল ইসলাম
  • প্রকাশিত ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তার প্রকাশ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এবং ৩০ লাখ তাজা প্রাণের বিনিময়ে আমরা লাভ করেছি মুক্তির স্বাদ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাই বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তাই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকারের অনুষঙ্গ, পরিচয়ের উৎস। একাত্তরের আগে আমাদের ভূমি ছিল, মাতৃভূমি ছিল না। দেশ ছিল, স্বদেশ ছিল না।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে যে অন্যায়, অবিবেচক, অপ্রত্যাশিত, অমূলক যুদ্ধ চাপিয়ে পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল, ইতিহাসে তা বিরল। ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল ওরা। এক্ষেত্রে নারী, শিশু, বৃদ্ধ কাউকেই বিবেচনা করা হয়নি। নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে নিরস্ত্র, নিরপরাধ মানুষকে। আড়াই লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে। এত বড় গণহত্যা পৃথিবীর কোথাও হয়েছে বলে জানা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে যে নিষ্ঠুরতা হয়েছে, তা পৃথিবীর একক কোনো রাষ্ট্র বা জাতির ওপর হয়েছে বলে জানা যায় না।

দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৭১ সালে সংঘটিত এই ভয়াবহ গণহত্যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি আজো। বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘গণ্ডগোল’, ‘গৃহযুদ্ধ’, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে কোনো কোনো মহল থেকে। তবে সংজ্ঞাগত ও তাত্ত্বিকভাবেই বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে’ গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ আছে। কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া- এই পাঁচটি উপাদানের কোনো একটি থাকলেই তা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে। বিশ্লেষকদের মতে, শেষটি ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আর সব ধরনের অপরাধই সংঘটিত হয়েছে। তাই একে গণহত্যা না বলার কোনো কারণ নেই।

এসব বৈশিষ্ট্য থাকার পরও বাংলাদেশের গণহত্যা স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনীহাকে দায়ী করা যেতে পারে। আবার নিজের দেশের ভূমিকাও এক্ষেত্রে জোরালো থাকতে হবে। বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি কানাডা, আর্জেন্টিনা ছাড়াও বিশ্বের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি ও ডিপল ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকোরি, ইউনিভার্সিটি অব হংকং এবং পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লজে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি পড়ানো ও গবেষণা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী দ্বারা যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল তা কোনো অভিযান ছাড়াই সংঘটিত হয়। একে হলোকাস্ট বলা যায়। ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে।

অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকোরির স্কুল অব ল’তে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন একাধিক গবেষক। ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুজনা লিন্টন ‘কমপ্লিটিং দ্য সার্কেল : অ্যাকাউন্টেবিলিটি ফর দ্য ক্রাইমস অব দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন’ শিরোনামে একটি গবেষণা করছেন। পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লজের শিক্ষক টমাস লাওস্কি সম্প্রতি ২০১২ সালে ‘ট্রানজিশনাল জাস্টিস অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট অন সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারনাল স্ট্যাবিলিটি ইন সাউথ ইস্ট এশিয়া : দ্য কেস অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন।

বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে চর্চার বিশ্বজনীন তাৎপর্য আছে। বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও তাদের দোষরদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এই গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতি দরকার। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম গণহত্যার মতো একটি ভয়াবহ ঘটনার মধ্য দিয়ে। তাই এই জন্মের ইতিহাস প্রজন্মান্তরে সক্রিয় রাখা দরকার। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোনো জনগোষ্ঠীর আন্তরিক তৎপরতা থাকলে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় যে সম্ভব, তার প্রমাণ আর্মেনিয়া। ১৯১৫ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের শেষদিকে তুরস্কে ১৫ লাখ আর্মেনীয় গণহত্যার শিকার হয়। গত শতাব্দীর এটিই প্রথম গণহত্যা বলে স্বীকৃত। বছর বিশেক আগে থেকে ওই হত্যাকাণ্ড গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। এ পর্যন্ত ফ্রান্স, রাশিয়াসহ ২০টি দেশ ওই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

বাংলাদেশের গণহত্যা বিষয়ে বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুল-কলেজের সিলেবাসে গণহত্যা বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক। আর্মেনীয়দের মতো সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি বিশ্বের বুকে বীরত্ব ও আত্মদানের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর পরাজয় বাঙালি জাতিকে এই পৃথিবীর আঙিনায় স্বাধীন সত্তা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও একাত্তরের গণহত্যার বিশ্বজনীন স্বীকৃতি মেলেনি। পরাজিতরা আজো সক্রিয়। তাই বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের থামেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে গ্রহণ করতে হবে, ছড়িয়ে দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

 

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads