এদেশে সবকিছু চাপা পড়ে যায়। খুন জখম রাহাজানি ধর্ষণ চুরি ডাকাতি নিয়ে আলোড়ন ওঠে। বক্তৃতা বিবৃতি টকশো টেবিল চাপড়ানো চলে বেশ কদিন। আইনকানুন, তদন্ত-বিচারের কথাও শুনি। দু’একজন গ্রেপ্তার হয়। তারপর সব থেমে যায়, যেন অতলে তলিয়ে যায়। খুব বেশি দূর নয়, নুসরাতকে দিয়ে শুরু করি। নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হলো। সারা দেশ সোচ্চার হয়ে উঠল। আন্দোলন মানববন্ধন সভা-সমাবেশে নুসরাত হত্যাকারীর বিচার দাবি করা হলো। সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় হয়ে গেল বিচারের দাবিতে। মাদরাসার অধ্যক্ষ ধরা পড়ল। দুই-চার দিন নুসরাতকে নিয়ে আলোচনা হলো। তারপর সব চাপা পড়ে গেল রিফাতের মৃত্যুর ঘটনায়।
প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে খুন করা হলো রিফাতকে। তার স্ত্রী মিন্নি প্রাণপণ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। রিফাতের পিতা মামলা করল নয়ন বন্ডসহ কয়েকজনকে আসামি করে। প্রধান সাক্ষী মিন্নি। দিন কয়েকের মধ্যে বদলে গেল দৃশ্যপট। ঘটনা মঞ্চে আবির্ভাব ঘটল কতিপয় ক্ষমতাবান লোকের। অঙ্গুলি হেলনে সাক্ষী হয়ে গেল আসামি। নয়ন বন্ড ক্রসফায়ারে নিহত হলো। মিন্নি গ্রেপ্তার হলো। কেন নয়ন বন্ডের জন্ম হলো, কে তাকে নয়ন বন্ড বানাল, কেন তাকে মেরে ফেলা হলো—সেসব প্রশ্ন প্রশ্নই রয়ে গেল। চাপা পড়ে গেল মিন্নির ঘটনা সায়মা হত্যার ঘটনায়।
নিজ বিল্ডিংয়ে বান্ধবীর সঙ্গে খেলার জন্য অন্যতলায় গিয়েছিল সায়মা। বান্ধবী ঘুমিয়ে আছে জেনে লিফট দিয়ে নেমেও আসছিল। লিফটে দেখা হয়ে গেল এক লোকের সঙ্গে। লোকটিকে বান্ধবীর বাসায় দেখেছে। ছাদ দেখানোর নাম করে সায়মাকে সে নিয়ে গেল একটা পরিত্যক্ত কক্ষে। সেখানে তাকে ধর্ষণ করল। সায়মা চিৎকার-চেঁচামেচি করলে তাকে মেরে ফেলল। সায়মা হত্যার ঘটনায় তোলপাড় হলো দেশ। আগের মতো সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন হলো বিচারের দাবিতে। হত্যাকারী ধরা পড়ল। সায়মার মায়ের আর্তনাদে ভারি হয়ে থাকল পুরান ঢাকার বাতাস। এখনো কাঁদছে সায়মার মা। কিন্তু সে ঘটনা চাপা পড়ে গেল তাসলিমা বেগম রেনুর হত্যার ঘটনায়।
রেনু চার বছরের মেয়ের স্কুলের ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন বাড্ডার একটা স্কুলে। সেখানেই তিনি গণপিটুনির শিকার হন। ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় তাকে। পৈশাচিক আনন্দে তাকে পেটাল শত শত মানুষ। বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। কেউ একবারের জন্যও বলেনি, ওকে মেরো না। বরং যারা পিটুনিতে অংশ নেয়নি তারা দৃশ্যটি ভিডিও করতে ব্যস্ত ছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল রিফাতের বেলাতেও। একদল কোপাচ্ছিল আর একদল ভিডিও করছিল। আর পুলিশই বা কোথায় ছিল? পুলিশরা আসলে কোথায় থাকে? রিফাতের ঘটনা, রেনুর ঘটনা-দুটিই ঘটেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে প্রকাশ্য স্থানে। পুলিশ ভাইদের দেখা তাহলে মিলল না কেন? ঘটনার সময় কেন তাদের দেখা মেলে না—এ প্রশ্ন আমার অনেক দিনের। যাক যা বলছিলাম। রেনু বলার সুযোগই পায়নি সে কে, কেন এসেছিল। বলার সুযোগ পায়নি, সে এক অভাগী মা। অনেক কষ্টে সন্তান মানুষ করছে। তাদের বড় করার স্বপ্ন দেখছে। কিছুই বলতে পারেনি। তার আগেই তার হূদযন্ত্রটি বিকল হয়ে গেছে। হূদয় নামের এক ছেলে ধরা পড়েছে। ব্যস রেনু কাহিনি চাপা পড়ে গেল। এখন তার মেয়েটি বলছে, মা নেই মা নেই। তার মা যে নেই তাতে কার কি যায় আসে! এটা তো কল্যাণ রাষ্ট্র নয়, একজন নেই হলে আরেকজনের কিছু যায় আসে। যাক, রেনুর ঘটনা চাপা পড়ে গেল প্রিয়া সাহার আবির্ভাবে।
প্রিয়া সাহা নামে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক নেত্রী হোয়াইট হাউজে গিয়ে বলে বললেন এদেশে ৩৭ মিলিয়ন সংখ্যালঘু নিখোঁজ হয়েছে। তিনি ট্রাম্পের সাহায্য চাইলেন যেন এদেশের সংখ্যালঘুরা নিরাপদে বাস করতে পারে। ব্যাপারটা এমন যেন ট্রাম্প আমাদের মুরব্বি। প্রিয়া সাহা যে নিরাপদে সহিসালামতে আছেন সেটা তো স্পষ্ট। নাহলে তিনি ট্রাম্প পর্যন্ত পৌঁছালেন কীভাবে! কেউ বলল, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে গেছেন। কেউ বলল আমেরিকার গর্ভমেন্টের আমন্ত্রণে গেছেন। কোনটা সত্যি আমরা সাধারণ পাবলিক জানতে পারলাম না। যাহোক মন্ত্রীরা সোচ্চার হলেন, প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেন। কিন্তু যেমন তারা বেলুনের মতো দ্রুত ফুললেন তেমনই কি এক ইশারায় চুপসেও গেলেন। ললিত সুরে বললেন, দেশে আসলে প্রিয়া সাহা গ্রেপ্তার হবেন না। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হবে ইত্যাদি। প্রিয়া সাহা তার বক্তব্যে অটল রইলেন। তিনি আমেরিকাতেই আছেন। এত বড় একটি ঘটনা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। ভাবখানা এমন, কোনোদিন এমন কোনো ঘটনা ঘটেইনি।
প্রিয়া সাহার কাহিনি অতলে হারানোর আগেই হুড়মুড় করে ধেয়ে এলো কয়েকটি ঘটনা। ভারতের ‘সারেগামাপা’ শোতে তৃতীয় স্থান বিজয়ী নোবেল জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক তুললেন। একজন যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় ফেরি না ছাড়ায় মারা গেল এক কিশোর। দেশব্যাপী বন্যা পরিস্থিতির ভয়ানক অবনতি হলো। মানুষ, গরু-বাছুর, ফসল তলিয়ে গেল। খাদ্যের অভাবে মানুষ হাহাকার করতে লাগল আর একই সঙ্গে শুরু হলো ডেঙ্গুর প্রকোপ। যদিও প্রথম দিকে বলা হলো, ডেঙ্গুর বিষয়টি গুজব। আসলে ডেঙ্গুর কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। পা ফেলবার জায়গা ছিল না। প্রতিদিনই কারো না কারো মৃত্যুর খবর আমরা পাচ্ছিলাম। যাদের চিনি তাদের কারো এমন পরিণতি হলে খবর পাচ্ছিলাম, যাদের চিনি না তাদেরটা পাচ্ছিলাম না। তবে পরিস্থিতি যে মারাত্মক ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুই দিন আগে যারা গুজব বলছিলেন তখন তারা নতুন লম্বা লম্বা ঝাড়ু কিনে সেজে-গুজে রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। সে দলে মন্ত্রী থেকে ভিসি পর্যন্ত ছিলেন। কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী শিল্পী কেউ বাদ যাননি তখন। একজন যখন করছে অন্যকেও করতে হবে। পিছিয়ে পড়লে তো চলবে না। সেই ধান কাটার মতো। ঝকঝকে রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে তারা এডিস মশার লার্ভা তাড়াচ্ছেন। অথচ বস্তিগু চারপাশে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে আশার কথা, ঝাড়ু বিক্রেতাদের এই মওকায় ভালো বিক্রি হয়েছে। সামনে ঈদ ছিল। সব তো বড়রা লুটেপুটে খাচ্ছে। এই সুযোগে দুটো পয়সা তাদের ঘরে আসলে মন্দ কী?
ঝাড়ুর ছবি দেখতে দেখতে যখন আমরা ক্লান্ত এবং বিরক্ত তখনই পেলাম ভয়ানক খবরটি। সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত কতিপয় ব্যক্তি উড়াল বক্তৃতা দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে ছবিসহ লিড নিউজ হলো। এ বিষয় নিয়ে একটা আর্টিকেলও অনলাইনে লিখলেন একজন নামজাদা সাংবাদিক। পরে কেন লেখাটি নামিয়ে ফেলা হলো জানি না। ওই ব্যক্তিরা ঢাকায় বসে প্রতিদিন গড়ে ১৪টি করে বক্তৃতা দিয়েছেন আর এই বক্তৃতাবাবদ কোটি কোটি টাকা তারা পকেটে পুরেছেন। বক্তৃতা হয়েছে দেশব্যাপী। আমলা, পুলিশ ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির অনেক কথা আমরা জানি। কদিন আগে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রে বালিশ কেলেঙ্কারি হয়েছিল। প্রতিটি বালিশের মূল্য পড়েছিল সাড়ে ছয় হাজার টাকা। নিচতলা থেকে দোতলায় তোলার খরচ বালিশপ্রতি ৭২০ টাকা। তখন পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল এটাই নাকি সবচেয়ে বড় লুটপাটের ঘটনা। তাহলে এটা কী? চৌষট্টি বিদ্যার এক বিদ্যা চুরি বিদ্যা। চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা। দলবেঁধে চুরি করলে একটা সুবিধা আছে। সবাই ভাবে একসঙ্গে যখন আছি কিছু হবে না। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। ওনারা আসলে কী করেছেন তা ওনারা জানেন। আর আছে কাপজপত্র-রেকর্ডে। ক্ষমতায় থেকে কাগজপত্র রেকর্ড বদলানো কঠিন কাজ নয়। এদেশে ক্ষমতাশালীরা অদ্ভুত এক জাদুতে সব ম্যানেজ করে ফেলে। ম্যানেজ করার নমুনা তো ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে ওনারা শপথ নিয়েছেন সৎ থাকার, নিরাসক্ত থাকার, পদের মর্যাদা রক্ষা করার। ওনাদের বাড়ির সামনে জাতীয় পতাকা ওড়ে। ওনাদের কেউ কেউ নীতিবাগিশ বাক্যবাগিশ। বড় বড় নীতি আর অনিয়ম অব্যবস্থার কথা বলেন। ক্ষমতা খর্ব করা, কমিশনকে হেয় করার প্রশ্ন তুলে অতি সাধারণ ঘটনায় নালিশ করে গরিব মানুষের চাকরি খেয়ে ফেলেন। সারাক্ষণ মিডিয়া কাভারেজ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। তা এই নীতিবাগিশের এ কেমন নৈতিকতা? টাকার প্রশ্নে সব নৈতিকতা জলে ভেসে গেল। সব এককাট্টা হয়ে গেল! হ্যাঁ তাদের কারো কারো বড় বড় অসুখ-বিসুখ আছে। সে চিকিৎসার টাকাও জনগণ দেয়। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তারা ব্যাঙ্কক সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করেন। আর যে জনগণ ট্যাক্স দেয় তারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করায়। অতি উচ্চ বেতন, তিন-চারটে গাড়ি, বাড়ি, পুলিশ, চাকর-বাকর মালি, দারোয়ান সব তারা পান। তারা এমন কী মহৎ কাজ করেন, এত কিছু তাদের প্রাপ্য? তারা মাসে যা পান ২০টা সাধারণ পরিবার সে টাকায় খেয়ে-পরে বেঁচে যায়। আর এত পাওয়ার পরও তাদের ক্ষুধা মেটে না। উড়াল বক্তৃতার টাকা খেতে হয়! অথচ সারা জীবন প্রশাসনে চাকরি করে জানতে পারিনি, কাজের অংশ যে বক্তৃতা সেটা দেওয়ার জন্য টাকা পাওয়া যায়। এটা প্রথম জানলাম।
অন্য ১০টি ঘটনার মতো এ ঘটনাটাও চাপা পড়ে গেল। হারিয়ে গেল কালের গহ্বরে। ওই কাহিনি শেষ হতে না হতেই বুয়েটে ঘটল আবরার হত্যাকাণ্ড। নাইমুল আবরার শর্টসার্কিটে মারা গেল একটা কনসার্ট চলার সময়। দুই-দুটি তাজা প্রাণ চলে গেল। কিছুদিন আলোচনা হলো। এখন সবই স্তিমিত।
মনোজব সুর ‘নিশিকুটুম্ব’ উপন্যাসের সাহেবের কথা খুব মনে পড়ছে। খেতে না পেয়ে সে রানীর কানের মাকড়ি চুরি করেছিল। চুরি করেছিল অভাবে। শতকোটি টাকা থাকার পরেও এরা চুরি করে স্বভাবে। সাহেবকে আমাদের চোর মনে হয় না, মনে হয় না সে কোনো অপরাধ করেছে। আশালতার জন্য প্রাণ কাঁদে। আর শপথবাক্য উচ্চারণ করা এসব মানুষের জন্য ঘৃণার পাহাড় জমে।
সব শেষে এই প্রত্যাশা, বিষয়গুলো যেন চাপা পড়ে না যায়। দেশের মানুষের অধিকার আছে সত্য জানার। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আবরার হত্যার চার্জশিট হয়েছে জেনে আমাদের আশার উদ্রেগ হয়েছে। সত্য বিচার হোক, ন্যায় প্রতিষ্ঠা পাক—এটাই আমাদের চাওয়া।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব