চর কুকরিমুকরিতে ক্যাম্পিং

সংগৃহীত ছবি

ভ্রমণ

চর কুকরিমুকরিতে ক্যাম্পিং

  • প্রকাশিত ৫ মার্চ, ২০২১

রেজাউল মুক্তাদীর

দ্বীপ জেলা ভোলার অন্তর্গত চরফ্যাশন উপজেলার একটি ইউনিয়ন চর কুকরিমুকরি। বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষে এর অবস্থান। মেঘনা নদীর একটি মোহনা মিলিত হয়েছে চর কুকরিমুকরির সম্মুখে। এখানে আছে ম্যানগ্রোভ জলাভূমি ও বন্য জীববৈচিত্র্য। নাইট ক্যাম্পিংয়ের জন্য একটি চমৎকার জায়গা এটি। চলুন জেনে নেওয়া যাক চর কুকরিমুকরিতে ক্যাম্পিংয়ের খুঁটিনাটি। আশা করি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ট্রাভেলারদের ভালো লাগবে।

যেভাবে যাবেন: বরিশাল লঞ্চঘাট থেকে প্রথমে ভোলাগামী লঞ্চে উঠতে হবে। এই লঞ্চগুলো একটু ছোট আকারের হয়। লঞ্চ ছাড়ে ভোর ৬টায় একটা আর ৭টায় একটা। অন্যান্য সময়েও ছাড়ে। কিন্তু ঐদিন রাতে ক্যাম্পিংয়ের ইচ্ছা থাকলে আপনাকে এই দুটোর যে-কোনো একটাতেই রওনা হতে হবে। ভাড়া নেবে ৯০ টাকা প্রতিজন। লঞ্চে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার মতো যাত্রায় আপনি উপভোগ করবেন বিভিন্ন ছোট ছোট চরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রিভার জিপসি (নৌকার বেদে),  অনেকের বাড়ির একদম পাশ দিয়েই লঞ্চ যাবে যা বেশ ইন্টারেস্টিং। এরপর লঞ্চ থামবে ভোলা লঞ্চঘাটে। এখানে নামতে হবে। নেমে এখান থেকে যেতে হবে ভোলা বাস টার্মিনালে। ইজি বাইক, ভ্যান বা বাসে যেতে পারেন। তবে যাওয়ার দিন বাসে যাওয়াই ভালোণ দ্রুত ও সহজ হবে যাওয়া, সময় বাঁচবে। বাসে গেলে সময় লাগবে ৩০ মিনিটের মতো, ভাড়া প্রতিজন ১৫ টাকা। ভোলা বাসস্ট্যান্ড থেকে চরফ্যাশনের বাসে উঠতে হবে। ডিরেক্ট বাস ভাড়া ১৪০ টাকা প্রতিজন আর লোকালে গেলে ৮০/৯০ টাকা প্রতিজন। বাসে মোটামুটি আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে ডিরেক্ট বা লোকালে কমবেশি। চরফ্যাশন বাজারে বাস থেকে নামিয়ে দেবে। ওখান থেকে আরেকটা বাস ধরে যেতে হবে দক্ষিণ আইচায়, ভাড়া নেবে ৩০ টাকা প্রতিজন। দক্ষিণ আইচায় নেমে ব্যাটারিচালিত একটা রিকশা নিয়ে যেতে হবে কচ্ছপিয়া ঘাটে। এখান থেকে যেতে হবে চর কুকরিমুকরি। এখান থেকে ইঞ্জিন ট্রলারে যেতে পারেন; কিন্তু সেটা ছাড়ে দুপুর ৪টায়। এটায় গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে ক্যাম্পিংয়ে, তাই স্পিড বোটে যাওয়াই ভালো। স্পিড বোটে ২০০ টাকা মাথা প্রতি ভাড়া নেবে। মোটামুটি ৪০ মিনিট মতো লাগে স্পিড বোটে। আপনাকে নামিয়ে দেবে চর কুকরিমুকরির ঘাটে।

খাওয়াদাওয়া: ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্যে গেলে আপনাকে বরিশাল শহর থেকে পর্যাপ্ত অয়েল ক্লথ কিনতে হবে, যেটা মাটিতে বিছাবেন, সাথে পর্যাপ্ত ম্যাচ/লাইটার ও ব্যাটারিচালিত টর্চলাইট মেন্ডেটরি। রাতে নিজেরা বার্বিকিউ করতে চাইলে বার্বিকিউর অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল পেপার, রেডি মসলা, সস, লবণ, ঝাল মসলা ইত্যাদি উপকরণ বরিশাল থেকেই নিয়ে নেওয়া ভালো।

চর কুকরিমুকরিতে ট্যুরিস্ট দেখানোর মতো একমাত্র গাইড আমার জানামতে যিনি তার সেলিম চাচ, উনার যোগাযোগ নম্বর-০১৭৮০-১৩১০৫৮। সেলিম চাচার সাথে যাবার আগে কথা বলে জানিয়ে দেবেন কতজন যাবেন, ক্যাম্পিং করবেন কি না। সে অনুযায়ী তাঁবুর ব্যবস্থা আগে থেকে করে রাখবেন। সাথে বালিশ লাগলে বালিশের কথা বলবেন।  কতদিন ক্যাম্পিং করবেন সেটাও স্পষ্ট করবেন। খাবারদাবারের ব্যবস্থাও উনিই করবেন সেভাবে কথা বলে নেবেন। আমরা যেদিন গিয়েছি সেদিন দুপুর রাত দুই বেলা আর পরদিন সকালে খেয়েছি, চার্জ এসেছে প্রায় ১৭০০ টাকা (৪ জন), আইটেম ছিল ভাত, ইলিশ, মুরগি, ডাল ও সকালে রুটি ও ভাজি। আমাদের চারজনের জন্য সব মিলায়ে বাজার করছে ২টা ইলিশ ও একটা মুরগি। বার্বিকিউ করতে চাইলে সেটা আলাদা বলতে হবে। কী মাছ খাবেন সেটা জানাতে হবে। মাছ পাওয়া যায় মৌসুম অনুযায়ী। এখন পাওয়া যাবে ইলিশ। আমরাও ইলিশ বার্বিকিউ করেছি। ৪টা মাঝারি জাটকা নিয়েছে ৫০০ টাকা। তবে নিজেরা জেলেদের কাছে খোঁজ করলে ছোট চিংড়ি বা অন্য ছোট ছোট মাছও পেতে পারেন বা চাইলে চিকেন বার্বিকিউও করতে পারবেন। ক্যাম্পিং আইল্যান্ডে বসে ডাব খেতে চাইলেও বলতে পারবেন।

যাবার দিন কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে স্পিড বোটে কুকরিমুকরি পৌঁছাবার পর সেলিম চাচার বাড়ি যেতে হবে বাইকে। বাইকে জনপ্রতি ভাড়া ৩০ টাকা। আপনি যদি ঐদিন দুপুরে সেলিম চাচার কাছে না খেতে চান তবে কুকরিমুকরি বাজারে হোটেল আছে সেখানেও খেয়ে নিতে পারেন, খরচ কম পড়বে।  দুপুরে খাওয়ার পর তখনই যেতে হবে নৌকায় করে চর পাতিলার দুমে। এখানেই রাতে ক্যাম্পিং করতে হবে। যাওয়া ও ফেরার সময় আসা মিলে নৌকার চার্জ নিয়েছে ৫০০ টাকা।

ক্যাম্পিং: ক্যাম্পিং হবে যে চরটায় তার নাম চর পাতিলার দুম। এটা কুকরিমুকরির মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটা অংশ, মেঘনার মোহনার বুকে জেগে ওঠা ছোট একটা অংশ। এই চরে আপনি সমুদ্রসৈকতের ফ্লেভারই পাবেন। কেননা বেলাভূমির সামনেই সাগর স্পষ্ট দেখতে পাবেন, সাথে গর্জন ও শুনতে পাবেন জোয়ারের সময়।  কুকরিমুকরি থেকে নৌকায় যাবার সময় খালের দুই পাশে ম্যানগ্রোভ বন দেখতে পাবেন, অনেকটাই সুন্দরবনের মতো। এখানে নানা রকমের প্রাণী আছে গুইসাপ, হরিণ, শিয়াল, মেছোবাঘ ইত্যাদি। যেতে যেতে এই খাল মূল মেঘনার মোহনায় গিয়ে মিশেছে যা দেখতে পাবেন।

চর পাতিলার দুমের সৈকতের পেছনে যে জঙ্গল সেখানে ক্যাম্প করতে হবে। একটি তাঁবুতে দুজন থাকতে পারবেন।  ভালো করে আগুন করতে হবে একটা যেটা সারারাত জ্বলবে। আগুনটা খুবই ইম্পোরট্যান্ট। এই চরে আপনি ছাড়া আর কেউই নাই এটা মনে রাখবেন। সেলিম চাচা শুধু খাবার দিতে রাতে একবার আসবে, তারপর চলে যাবেন। এরপর আপনিই আপনার সঙ্গী পুরো দ্বীপে। বনের প্রচুর উইপোকা আর মশা আছে, তাই মশার কয়েল রাখতে হবে পর্যাপ্ত। আগুনের জন্য শুকনা কাঠ নিজেদেরই দ্বীপ থেকে খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করতে হবে। আগুনের জন্য সাথে কেরোসিন রাখতে পারেন বা সেলিম চাচাকে বললেও উনি দিয়ে যাবেন। সন্ধ্যার পর শেয়ালের ডাকাডাকি অহরহ শুনতে পাবেন, সাথে সাগরের গর্জন। আর মাথার ওপর মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির স্পষ্ট ভিউ পাবেন। রাত ১০টা ৩০ মিনিটের পর থেকে জোয়ার আসার সাথে সাথে সৈকতে পানির লেভেল ক্রমেই আপনাদের কাছাকাছি আসতে থাকবে। আমাদের সময় পানি অনেকটাই কাছে চলে এসেছিল। এমন একটা পর্যায় এসছিল যে সবাই ভেবেছিলাম যে হয়তো তাঁবু তলিয়ে যাবে। তাই গাছে ওঠার প্রস্তুতি নিয়েই রাতে ঘুমোতে গিয়েছি। যদিও সৌভাগ্যক্রমে আর এগোয়নি। সামান্যের জন্যই ক্যাম্প তলিয়ে যায়নি। তবে নিম্নচাপ হলে বা জলোচ্ছ্বাস হলে পরিস্থিত বেগতিক হতেও পারে। তাই সব রকম মানসিক প্রস্তুতি রাখা ভালো। আমাদের সাথে টর্চ না থাকায় একটু সমস্যায় পড়তে হয়, তাই টর্চ রাখবেন যতগুলো পারেন। গভীর রাতে জঙ্গলে বের হলে হরিণ দেখতে পাবেন।

সব মিলিয়ে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের চমৎকার লাগবে এখানে। শীতের মৌসুমে ট্যুরিস্ট আসে ঘুরতে বেশি, তাই ন্যাচারাল ফ্লেভার পেতে বর্ষার পর পর যেতে পারেন। ফেরার রাস্তা আসার রাস্তার মতো একই, তবে ফেরার দিন কুকরিমুকরি থেকে মাছ ধরা ট্রলারে করে আসতে পারবেন।

কিছু সচেতনতা ও সতর্কতা:

১. এই অঞ্চলের মানুষ কিছুটা ধর্মভীরু। তাই বান্ধবীদের নিয়ে যদি এখানে ক্যাম্পিং করতে যান তাহলে মাঝে মাঝে বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেও পড়তে পারেন। কারণ এটা এখনো অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর মতো হতে পারেনি। তাই সবার মানসিকতাও ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি না। আপনাকে আপনার অগোচরে স্থানীয়রা জাজ করবে, ভিন্নভাবে দেখবে যেটা অনেক সময় সুবিধাজনক পরিস্থিতি নাও হতে পারে। স্বামী-স্ত্রী যেতে পারেন নির্দ্বিধায়, তবে ভারী গহনা না নেওয়াই ভালো। মনে রাখবেন, এটা একদম সাগরের কোলঘেঁষা একটা চরাঞ্চল। এখানে সবাই নিত্যদিন প্রকৃতির সাথে লড়াই করে জীবন ধারণ করে।

২. সেলিম চাচা এমনি মানুষ ভালো, তবে আগে থেকে তার সাথে সব বিষয়ে খোলাখুলি চুক্তি করে নেবেন এবং অন্য যাদের কাছ থেকে যা কিছু নেবেন চুক্তি করে নেবেন।  না হলে পকেট সাবাড় হয়ে যাবে বুঝতেও পারবেন না। আমরা একরাত ক্যাম্পিং করেছিলাম কিন্তু তাঁবুর ভাড়া দুরাতের জন্য নিতে চেয়েছিল। পরে জোর করায় আর নেয়নি। এরকম আরো বেশ কিছু ব্যাপার রয়েছে। তাই একটু সতর্ক হবেন।

৩. যারা একটু দুর্বল চিত্তের তাদের এখানে ক্যাম্পিং না করাই ভালো, অন্তত শীতের আগের মৌসুমে।

৪. দয়া করে ক্যাম্পিংয়ের পর আগুন খুব ভালোভাবে নিভিয়ে ফেলবেন ও বনে বা সৈকতে প্লাস্টিক বোতল বা প্যাকেট বা বর্জ্য ফেলে আসবেন না। এতে জায়গাটির পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads