ঘুরে আসুন ফেনী

মহামায়া লেক

ছবি : বাংলাদেশের খবর

ভ্রমণ

ঘুরে আসুন ফেনী

  • সাহিদা সাম্য লীনা
  • প্রকাশিত ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

ষড়ঋতুর মধ্যে শীতকাল এদেশে আসে ভিন্ন এক মুগ্ধতা নিয়ে। মানব মন বেড়ানোর এক শীতল চিঠি নিয়ে। দেশ-বিদেশের মানুষ এ সময়টা বেশ উপভোগ করে ঘুরতে। একসময় সবাই ছুটত কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, সিলেটের জাফলং, চা-বাগান, সুন্দরবন, কুয়াকাটা দেখতে। আর বিদেশ যাওয়া তো বড়লোকদের জন্য বাড়তি আনন্দ।

তবে এখন সব শ্রেণিপেশার মানুষের রুচি, চাহিদায় পরিবর্তন এসেছে। সময়ের সঙ্গে মন-মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে অনেক। দিন যতটা এগিয়েছে মানুষের জানা, দেখা, বোঝার আগ্রহ তৈরি হয়েছে ব্যাপক। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নানা স্থানের ছবি পোস্ট একেক জনের একেকটি ক্রেডিট যেন! কে কোথায় যাচ্ছে তার একটি আপডেট থাকে নিজেকে ও পরিবারকে প্রকাশের। তাই অনেকে আছেন দেশের ছোট ছোট অঞ্চলকে নতুনভাবে আবিষ্কার বা উপভোগ করতে ও ভ্রমণের স্মৃতি ধরে রাখতে।

৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক ছোট্ট ভূখণ্ড লাল-সবুজের বাংলাদেশ। ছোট্ট ভূখণ্ড হলেও প্রাকৃতিক অনন্যতা, পাহাড়, নদী, সাগর কি নেই এ দেশে! নব্বই আশি দশকে যত পর্যটক আসত, এখন তার চেয়ে বেশি পর্যটক আসছে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের আকর্ষণে। দেশের নানা প্রান্তে, বড় বড় শহর ছাড়িয়ে এখন ছোট ছোট শহরও পর্যটনের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। শীত এলেই দেশে একটা দীর্ঘ ছুটি বিরাজ করে। এ সময়টা বেড়ানোর একটা মৌসুমও বলা চলে।

আপনার ভ্রমণের জন্য তেমনি একটি ছোট্ট শহর ফেনী। এখানে বেশ কিছু স্থান রয়েছে, যেখানে আপনি আপনার ছুটিগুলো কাটাতে পারেন নিশ্চিন্তে।

প্রথমেই জেলার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত পরিচিত হোন। অনেকে ফেনীকে নোয়াখালীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। ফেনী এখন নোয়াখালীর অধীন নয়। একসময় এটি নোয়াখালী জনপদের একটি মহকুমা ছিল। প্রথম মহকুমার প্রশাসক ছিলেন একজন কবি, যার নাম কবি নবীনচন্দ্র সেন। ১৮৮১ সালের পর দুটোই আলাদা জেলায় রূপলাভ করে। বিভাগ করার দাবিও উঠেছিল দুটো জেলার একটিকে; যার যার জেলার প্রতি ভালোবাসা দিয়ে। ফেনী আসার পর আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাবে। দেশের প্রথম সিক্সলাইন ওভার ব্রিজটির পাশেই আপনাকে থামতে হবে। মহিপাল থেকেই মূলত ফেনীকে আপনি চিনে নিতে পারবেন।   

অবস্থানের দিক দিয়ে ফেনী জেলার উত্তরে কুমিল্লা জেলা ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, দক্ষিণে চট্টগ্রাম জেলা ও বঙ্গোপসাগর, পূর্বে চট্টগ্রাম জেলা ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং পশ্চিমে নোয়াখালী জেলা।

ফেনী ৬টি উপজেলা ও ৫টি পৌরসভার সমন্বয়ে গঠিত। স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, সুপার শপ, আধুনিক শপিং মল, ব্যায়ামগার, সুইমিংপুল সবই ছোট শহরকে এক নান্দনিকতা এনে দিয়েছে। সামান্য দূরত্বে এসবের সেবা পেতে পারেন, অভ্যস্ত যদি হন সেসব কাজে, কারো প্রয়োজনে। হাতের কাছেই মডেল থানা। যে কোনো নিরাপত্তায় শহর পুলিশ ফাঁড়ি ও র্যাব-৭ এর সহযোগিতা নিতে পারেন আপনার প্রয়োজনে।

 

উল্লেখযোগ্য পর্যটন এলাকা

ভাষাশহীদ আবদুস সালাম জাদুঘর। এটি দাগনভূঁইয়া উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামে অবস্থিত। বাংলাদেশের এক গর্বিত সন্তানের ভূমিতে পা রাখতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না। তার নামে সেখানে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরও রয়েছে। ইতিহাসের দলিলপত্র সেখানে সাজানো। দেখবেন একটি শহীদ মিনার ও সালামের একটি প্রতিকৃতি। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের অন্যতম এক বীর সন্তানকে উপলব্ধি করতে পারবেন বিনম্রে তার জন্মস্থানে।

দাগনভূঁইয়া প্রতাপপুর জমিদার বাড়ি। এখানে ১০টি ভবন ও ১৩টি পুকুর রয়েছে। একসঙ্গে এতগুলো পুকুর দেখার সৌভাগ্য হতে পারে আপনার। মহিপাল থেকে নোয়াখালীর বাসে উঠে সেবারহাট নেমে সিএনজি যোগে যেতে হবে প্রতাপপুর।  সেখানের মানুষের সহযোগিতায় এই ঐতিহাসিক বাড়ির সন্ধান পাবেন নিমিষে। চারিদিকে লতাপাতা-গুল্মে ঘেরা জমিদারদের যতসব কথা-কাহিনি মগজে ভাসবে। ঐতিহাসিক পুরাকীর্তির সন্ধান পাবেন নিমিষে। সালাম নগর দেখে সেখান থেকেও স্থানীয়দের সহযোগিতায় যেতে পারেন প্রতাপপুর জমিদার বাড়ি দেখতে।

ছাগলনাইয়া উপজেলায় শুভপুর ইউনিয়নে কৈয়ারা দিঘি, এক খুল্যা দিঘি, শিলুয়ার শীল, শুভপুর ব্রিজ, জমিদার বাড়ি, শমসের গাজীর দিঘি। পাশেই ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে বনবনানি, পাখির কলকাকলি দেখে মুগ্ধ হবেন শুভপুরে। সুড়ঙ্গপথ দেখে হারিয়ে যাবেন রাজা-বাদশাদের আমলে। একটু হেঁটেই বা গাড়িতে গিয়ে দেখতে পাবেন শমসেরগাজী বাঁশের কেল্লা। ভেতরে ও বাইরে সম্পূর্ণ বাঁশের তৈরি এ কেল্লা দেখে মনেই হবে না আপনি মফস্বল শহরে এসেছেন। অসাধারণ মেধার এক পরিচয় পাবেন এতে সন্দেহ নেই। সাতমন্দিরটিও এক নজর দেখতে পারেন এ উপজেলায়। সিএনজিযোগে মাত্র ৫০০-৭০০ টাকার মধ্যে উপভোগ করতে পারেন একটি দিন। খাওয়ার দোকান, হোটেলেরও ব্যবস্থা রয়েছে। 

একসঙ্গে পরশুরাম উপজেলায় বিলোনিয়া স্থলবন্দর দেখে আসতে পারেন। ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে বিলোনিয়া স্থলবন্দর চালু হয়।

এটি বাংলাদেশের ১৭তম স্থলবন্দর হিসেবে পরিচিত। বিলোনিয়া স্থলবন্দর উভয় দেশের বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। যদিও নানা সঙ্কটে এখনো এই বন্দর। প্রতিদিন দর্শনার্থীদের পদভারে মুখর থাকে স্থলবন্দরটি। সাধারণ নাগরিকদের ভেতরে ঢোকা যদিও যাবে না-এ ভেবে বাতিল করা যাবে না দেখা। কেননা একসময় পাঠ্যপুস্তকে পড়া বাংলাদেশের বন্দরের একটি দেখার আগ্রহ থাকতেই পারে। আপনার ভিআইপি জাতীয় পরিচিতি থাকলে সেক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ দেবে। পাসপোর্ট দেখিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে বিএসএফ চেকিং পয়েন্টে। ভারতীয় শিশুদের স্কুল রয়েছে, সে পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারেন। হিন্দি ভাষা জানা থাকলে আপনি কথা বলতে পারবেন সেখানে দু’দেশের কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে। দু’দেশের লোক পুলিশের বন্ধু বৎসল আতিথেয়তা ও সীমানা স্পট আপনার নজর কাড়বে।

সোনাগাজী মুহুরী প্রজেক্ট দেখে আসতে পারেন। দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষিত হয়েছে ইতোমধ্যে এ স্থানটি।  এই সোনাগাজীতেই জন্ম নিয়েছে প্রখ্যাত নাট্যকার কিংবদন্তি সেলিম আল দীন। তার বাড়িও চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সার ও জহির রায়হানের জন্মস্থানও এ ভূমিতে। তাদের নামে স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চাইলে তিনজন কৃতীর শৈশব কৈশোরের স্থানগুলো হেঁটে আসতে পারেন।

শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ইকোপার্ক। এটি ফেনীর সদরে কাজীরবাগ ইউনিয়নে অবস্থিত। আধুনিক সব ব্যবস্থার সঙ্গে গ্রামীণ সব দৃশ্য আপনার মন জুড়াবে। দূরত্ব অনুসারে যে কোনো বাহনে যেতে পারেন। সদর হাসপাতালের কাছাকাছি পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় মেয়েদের জন্য বাংলাদেশের তিনটি ক্যাডেট কলেজের একটি ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজ দেখতে পাবেন।

তৃপ্তি এগ্রোপার্ক রয়েছে নতুন রানীরহাটে। সদর হাসপাতাল থেকে রিকশা অথবা সিএনজি করে আসা যায়। ভাড়া রিকশায় ২০ টাকা এবং সিএনজিতে ৫ টাকা বা রিজার্ভ গাড়িও নিতে পারেন।

সদরের ধর্মপুরে রয়েছে আরেকটি পার্ক। পাহাড়ি আদলে প্রাকৃতিক অনন্যতায় ঘেরা এ পার্কের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। সিএনজিতে ২০০ থেকে ২৫০ এবং অটোতে ১০০ থেকে ১৫০-এ আসতে পারেন।

রাজাঝির দিঘি শহরের জিরো পয়েন্ট ও আশপাশের রোডের সঙ্গে সংযুক্ত। দিঘির আশপাশে হাঁটতেই এই দিঘি নিয়ে জনশ্রুতিগুলো জানতে পারবেন স্থানীয়দের মুখে। ফেনীর অন্যতম বিনোদন স্থান এই দিঘি ঘিরে বর্তমানে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ হাতে নিয়েছে প্রশাসন।

মহিপাল থেকে মাত্র ২ কিলোমিটারে রয়েছে নারকেলবাড়িয়া। রাজ্যের সব গাছ-গাছালিতে ভরপুর পুরো এলাকাটি। বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা ও মাশরুমের চাষও হয় এতে। ফেনী বিসিক শিল্পনগরীও দেখে নিতে পারেন এক নজর। শ্রমিকদের কাজ সরাসরি  আপনার জানা-অজানাকে দ্বিগুণ করে তুলবে।

বিজয়সিংহ দিঘি মহিপাল শহরেই। বিখ্যাত সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সিংয়ের এই অমরকীর্তি এই দিঘি। এখানে হোটেল থেকে মাত্র আধা কিলোমিটারেরও কম সার্কিট হাউজ রোড বলা হয় এর অবস্থান। মহিপাল থেকে রিকশায় ১০ টাকা, যে কোনো বাহনে যেতে পারেন পরিবার নিয়ে। দিঘির আশপাশে মুক্তিযুদ্ধের সময় অজ্ঞাত অনেকের কবর রয়েছে জনশ্রুতিতে। স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে জানবেন এই দিঘি খননের আরেক মজার লোককাহিনি। খাবার ও বসার ব্যবস্থা পাবেন। দিঘির নীল জলরাশির চারপাশে হাঁটতে বেশ মজা পাবেন।  হাঁটার জন্য পিচ রাস্তা সযত্নে নির্মিত। ঢাকার হাতিরঝিলের কিছু গাছের দৃশ্য দেখবেন। লাইটিং ব্যবস্থা রয়েছে। সন্ধ্যার পরে দিঘির রূপ অন্যরকম দৃশ্যে মাতোয়ারা করে তোলে এ লাইটিং। দিঘির পাশেই সার্কিট হাউজ;  জেলা প্রশাসকের অস্থায়ী বাসভবন।

রয়েছে মহামায়া। এটি যদিও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে পড়েছে। তবু ফেনী থেকে অনেক কাছে। লেক, পাহাড় ঘেরা এক অনন্য পরিবেশ। টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকে নদীতে নৌকা নিয়ে ভ্রমণ করতে পারেন। পিকনিকের জন্য অনেকে এখন এ মহামায়াকে বেছে নিয়েছে। লেকের স্বচ্ছ নীলাভ জল, চার পাশের সবুজের আদল, নীরব পরিবেশে হারিয়ে যেতে চায় যে কারো মন। এমন পরিবেশে পর্যটক টানতে নতুনভাবে যোগ হয়েছে কায়াকিং অ্যাডভেঞ্চার। সিএনজি, অটোরিকশা, কার-মাইক্রোযোগে মাত্র আধা ঘণ্টায় যাওয়া যাবে মহামায়ায়। খইয়াছড়া ঝরনাও মহামায়ার মতো মিরসরাইয়ে অবস্থিত।

ছোট্ট জেলায় এতসব পর্যটন কেন্দ্রে ঘোরার পরও না জানা অনেক কিছু এবং সরাসরি ফেনীর আঞ্চলিক ভাষা ও শুদ্ধতার রূপায়ণ আপনার নজরে এসে যেতেই পারে। তাই জেনে নিন ফেনীকে। এভাবে সব জেলাকে জানুন। আস্তে আস্তে পুরো আপনার স্বদেশ; বাংলাদেশকে চোখে দেখে সমৃদ্ধ হোন। জানান আগামী প্রজন্মকে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads