বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

গ্যাসের দাম দ্বিগুণের প্রস্তাব

গ্রাহকদের চরম ক্ষোভ প্রকাশ

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৯ জানুয়ারি, ২০২২

আবারো বাড়ছে গ্যাসের দাম। এবার প্রস্তাব করা হচ্ছে, দ্বিগুণের বেশি দাম বাড়ানোর। যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক মূল্য অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি খাতে সরকারের দেওয়া ভর্তুকির পরিমাণ কমেছে। তবে এ যুক্তি মানতে নারাজ জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, গ্যাস খাতের দুর্নীতি রোধ, মীমাংসিত সামুদ্রিক ব্লক ও স্থলভাগে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উত্তোলন চুক্তিতে ব্যর্থতার কারণেই গ্যাস খাতে ভর্তুকি টানতে হচ্ছে। এসব বন্ধ না করে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করাটা অগ্রহণযোগ্য।

বিভিন্ন যুক্তিতে গত ৬ বছরে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে তিন বার। গড়ে প্রতি দুই বছরে একবার করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি করা হলেও এবার দ্বিগুণ মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবে চরম ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। পাশাপাশি রাজধানীর অনেক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন না হওয়ায় মূল্য বৃদ্ধি প্রস্তাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা। 

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্রে জানা যায়, এর মধ্যেই বিতরণ সংস্থা বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড প্রস্তাব জমা দিয়েছে। কোম্পানিটি নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং চাঁদপুর জেলায় গ্যাস বিতরণ করে। বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড তাদের প্রস্তাবে এক চুলা ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা এবং দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া আবাসিক পর্যায়ে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারের বর্তমান মূল্য ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭.৩৭ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছে। সিএনজি প্রতি ঘনমিটার ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৬.০৪ টাকা, হোটেল রেস্টুরেন্টে ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯.৯৭ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭.০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৭.২ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৩.৮৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০.০৯ টাকা এবং চা শিল্পে ১০.৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। আরো প্রস্তাব করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও সার কারখানায় থাকা বর্তমানে ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯.৬৬ টাকা।

বিইআরসি সূত্রে জানা যায়, প্রতি ঘনমিটার তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি খরচ ৩৬ দশমিক ৬৯ টাকা। কিন্তু মুসক, অগ্রিম আয়কর, ফিন্যান্সিং চার্জ, ব্যাংক চার্জ, কমিশন, রি- গ্যাসফিকেশন চার্জ, ভোক্তা পর্যায়ে উৎসে কর সব মিলিয়ে মোট খরচ ৫০.৩৮ টাকা। এই বাড়তি মূল্য বিতরণ কোম্পানির ওপরে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে ভোক্তা পর্যায়ে দাম না বাড়িয়ে বিকল্প উপায় দেখছে না কর্তৃপক্ষ।

জানা যায়, ভর্তুকির চাপ কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। গ্যাস ও বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়াতে এর মধ্যেই পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে আনুষ্ঠানিক নোটিশ পাঠিয়েছে। এর অংশ হিসেবে গত সোমবার বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড প্রস্তাব পাঠায়। অন্যান্য কোম্পানিগুলোকেও দ্রুত প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে পেট্রোবাংলা। সূত্রে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই সকল কোম্পানির প্রস্তাব বিইআরসিতে জমা পড়বে।

এ প্রসঙ্গে বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল বলেন, মাত্র প্রস্তাব আসা শুরু করেছে। তবে কমিশনে প্রস্তাব করার কিছু নিয়ম রয়েছে, সেসব মেনেই কোম্পানিগুলোকে প্রস্তাব পাঠাতে হবে। সবগুলো কোম্পানির প্রস্তাব এলে তা বিশ্লেষণ করে নিয়ম অনুযায়ী গণশুনানির মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করে দেয় বিইআরসি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী, বাড়তি রয়েছে তরলিকৃত গ্যাসের দামও। যার চাপ পড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বাপেক্স ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডের গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারের গড় ক্রয়মূল্য ১ টাকা ২৬ পয়সা, কিন্তু শেভরনের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে ২ টাকা ৮৯ টাকা দিয়ে, অন্য আরেক কোম্পানি তাল্লো থেকে দাম আরো বেশি ৩ টাকা ১০ পয়সা করে। অন্যদিকে এলএনজির ক্রয়মূল্য ৩৬ টাকা ৬৯ টাকা। সকল চার্জ পরিশোধ শেষে এর মূল্য দাঁড়ায় ৫০ টাকা ৩৮ পয়সা।

এদিকে চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ মোট বরাদ্দ রাখা হয় ৪৯ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং সারের জন্য চলতি অর্থ বছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বলছে এই তিন খাতে বরাদ্দ দরকার ৭০ হাজার কোটি টাকা। এই ৫৮ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি কোনোভাবে মেটানো সম্ভব নয় বলে সূত্রগুলো বলছে।

জানা গেছে, জ্বালানি খাতে সরকার ভর্তুকি দেয় ৪ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ২ হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে। কিন্তু এলএনজি আমদানি করতে সরকারের এই মুহূর্তে প্রয়োজন ১৬০০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, জ্বালানি খাতে সরকার যে বরাদ্দ দিচ্ছে তা দিয়ে কোনোভাবেই ঘাটতি মেটানো সম্ভব না। সে কারণে গত নভেম্বরে ৯ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা ভর্তুকি চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। একদিনে আমদানি করা গ্যাসের দাম বাড়তি অন্যদিকে এ খাতে ভর্তুকি কম। এই দুই বিষয়কে সামনে রেখেই জ্বালানির দাম বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।

তবে এভাবে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির করাটা অযৌক্তি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইনফ্রাস্ট্রাকচার রাইটার ও সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাকটিভিস্ট ও প্রকৌশলী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, এটা অগ্রহণযোগ্য এ জন্য যে গ্যাস খাতের দুর্নীতিযুক্ত ব্যবস্থাপনা ঠিক না করে, নতুন উৎপাদনে না গিয়ে, সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থা (পাইপ লাইন) ঠিক না করে, গ্যাস চুরির সমস্যা সমাধান না করে শুধু দাম বাড়িয়ে এই খাত টেকসই করা যাবে না। ২০১৫ ও ২০১৭ সালেও বিভিন্ন স্তরে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল, তারপরও আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি মূল্য কমার পরেও চুরি, সিস্টেম লস, ভর্তুকি কমছে না। মূলত, দুর্নীতিপরায়ণতা, ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতা, বিতরণে নৈরাজ্য, গ্যাস চুরি ও অবৈধ সংযোগ, সরবরাহ লাইন থেকেই অবৈধ বিতরণ, ১২ শতাংশ সিস্টেম লস, অন্যায্য মিটারিং, এলএনজি আমদানির খরচ বাড়িয়ে দেখানো, এলএনজি ও গ্যাস পাইপ লাইনের প্রকল্পে ধীরতা। এসবের দায় কেন জনগণ নেবে। এমনকি মীমাংসিত সামুদ্রিক ব্লক ও স্থলভাগে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও নতুন উত্তোলন চুক্তিতে ব্যর্থতার কারণেই গ্যাস খাতে ভর্তুকি টানতে হচ্ছে। বিশ্বের দুর্নীতিমুক্ত দেশগুলোর আদলে যেকোনো প্রাথমিক জ্বালানির দাম নির্ধারণের স্থায়ী গাণিতিক মডেল দাঁড়া করাতে হবে। তবেই তা টেকসই ও বোধগম্য হবে। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে দেশীয় চাহিদা, আন্তর্জাতিক দর, বার্ষিক রাজস্ব প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন, মূল্যস্ফীতি, বিকল্প সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহদান কিংবা সহযোগী অন্য জ্বালানির দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার ব্যবস্থা।

বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট গৃহস্থালি কাজে ব্যবহূত গ্যাসের ক্ষেত্রে এক চুলার দাম ৪০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হয়। দুই চুলার ক্ষেত্রে ৪৫০ টাকার স্থলে করা হয় ৬৫০ টাকা।  এর পরের বছর আবারো গ্যাসের দাম বৃদ্ধিও প্রস্তাব করা হয়েছিল।

২০১৬ সালের ৩১ জুলাইতে আবারো গ্যসের দাম বৃদ্দির প্রস্তাব করা হয়। ওই সময় গৃহস্থালি কাজে ব্যবহূত (মিটারযুক্ত) প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭ টাকার স্থলে প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৬ টাকা ৮০ পয়সা। গৃহস্থালি কাজে সিঙ্গেল বার্নারের (এক চুলা) দাম ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ১০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছিল। দুই চুলার জন্য প্রস্তাব করা হয় ১ হাজার ২০০ টাকা।

২০১৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয। এবার দুই দফায় দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়। গ্রাহকভেদে গড়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম দুই ধাপে এক টাকা ৪৬ পয়সা বাড়ানো হয়। প্রথম ধাপের গ্যাসের দাম বাড়ে ১ মার্চ থেকে আর দ্বিতীয় ধাপে ১ জুন থেকে বাড়ানোর কথা বলা হয়। যদিও উচ্চ আদালতের হস্তক্সেপে দ্বিতীয় দফা দাম বৃদ্ধি করতে পারেনি। দাম বৃদ্ধির ফলে মার্চে এক চুলার জন্য মাসিক বিল ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা করা হয়। জুন থেকে এ দাম বৃদ্ধিও প্রস্তাব করা হয়েছিল ৯০০ ও ৯৫০ টাকা। একইভাবে গৃহস্থালিতে মিটারভিত্তিক গ্যাসের বিল প্রথম দফায় প্রতি ঘনমিটার ৭ থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ১০ পয়সা করা হয়।

দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তৎকালীন কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেছিলেন, দেশের সামগ্রিক জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সমাজে জ্বালানি ব্যয়ের বৈষম্য কমাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ জুলাইতে আবার বাড়ে গ্যাসের দাম। আবাসিক খাতে দুই চুলার খরচ ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা আর এক চুলার খরচ ৭৫০ টাকা থেকে ৯২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গৃহস্থালি মিটারে দাম বাড়ে প্রতি ঘনমিটারে ১২.৬০ টাকা। গড়ে দাম বাড়ে ৩২.০৮ শতাংশ।

এদিকে নিয়মিত বিরতিতে দুই বছর অন্তর গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হলেও রাজধানীর  অনেক এলাকায় গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে। রাজধানীর টিকাটুলি, গোরাপবাড়, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পল্লবী, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ীসহ অনেক এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সঙ্কটে ভূগছেন ওইসব এলাকার বাসিন্দারা। এর ওপর গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিও সংবাদে হতাশ ও ক্ষুব্ধ তারা।

যাত্রাবাড়ীর গোরাপবাগের বাসিন্দা সোহেল মিয়া জানান, কয়েক বছর ধরে ওই এলাকায় দুপুর ১২টার আগে গ্যাস আসে না। কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাওয়া যায় না। তার ওপর বছর বছর গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে গ্রাহকদের ভোগান্তি আরো বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, সরকারের উচিত জনগণের স্বার্থ সবার আগে দেখা। কিন্তু তা না করে জনগণের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads