দেশি সংস্কৃতি অঙ্গন ঠিক যেন একটি পরিবারের মতো। সবাই একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথী। সামনেই কড়া নাড়ছে নতুন বছর। পুরনো বছরের আনন্দ-বেদনাকে পেছনে ফেলে নতুনকে স্বাগত জানানোর প্রয়াস। কিন্তু বললেই কি ভোলা যায় বেদনা। এ বছর শোবিজ অঙ্গনের বেশ কয়েকজন গুণী ব্যক্তিত্বকে আমরা হারিয়েছি। যাদের স্মৃতি দেশি সংস্কৃতি অঙ্গনের সবার কাছে চলার পাথেয় হয়ে থাকবে। তাদের প্রস্থানের শোককে শক্তিতে পরিণত করে নতুন বছরে এগিয়ে যেতে হবে।
সিরাজ হায়দার
বাংলা চলচ্চিত্রের শক্তিমান অভিনেতা সিরাজ হায়দার বছর শুরুর দিকে ১১ জানুয়ারি হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সিরাজ হায়দার অভিনয় করেছেন যাত্রা, মঞ্চ, রেডিও, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রে।
সিরাজ হায়দার তার অভিনয় জীবনে চারশর বেশি সিনেমায় কাজ করেছেন। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সুখের সংসার’। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত এ চলচ্চিত্রে তিনি খলচরিত্রে অভিনয় করেন। পাশাপাশি তিনি দুটি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেন। একটি ‘সুখ’ ও অন্যটি ‘আদম বেপারী’। রুপালি পর্দার পাশাপাশি মঞ্চেও সমানভাবে অভিনয় করেছেন সিরাজ হায়দার। ১৯৭৬ সালে তিনি রঙ্গনা নাট্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন এবং অনেক নাটকের নির্দেশনা দেন।
শাম্মী আখতার
নন্দিত সঙ্গীতশিল্পী শাম্মী আখতার মারা যান ১৬ জানুয়ারি। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে স্তন ক্যানসারে ভুগছিলেন। মৃত্যুর দিন বিকালে তার শারীরিক অবস্থার অবনতির হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন শাম্মী আক্তার। তার গাওয়া গানের দুটি অডিও অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ‘ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’ চলচ্চিত্রের শীর্ষ সঙ্গীতের জন্য ২০১০ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তার কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পাওয়া উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো- ‘বিদেশ গিয়া বন্ধু তুমি আমায় ভুইলো না’, ‘মনে বড় আশা ছিল তোমাকে শুনাব গান’, ‘ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’, ‘এই রাত ডাকে ঐ চাঁদ ডাকে হায় তুমি কোথায়’, ‘আমার মনের বেদনা বন্ধু ছাড়া বুঝে না’, ‘আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী খোদার পরে তোমায় আমি বড় বলে জানি’, ‘আমি যেমন আছি তেমন রবো বউ হবো না রে’, ‘আমার নায়ে পার হইতে লাগে ষোলো আনা’ ইত্যাদি।
কাজী আজিজ আহমেদ
দেশের খ্যাতিমান গীতিকারদের একজন কাজী আজিজ আহমেদ। তিনি ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তার লেখা ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ গানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গান লেখার পাশাপাশি তিনি অসংখ্য সিনেমার কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেছেন।
খান আতার ‘অনেক দিনের চেনা’র সহকারী হিসেবে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করে পরবর্তীতে কাহিনীকার, সংলাপকার, চিত্রনাট্যকার এবং চিত্রপরিচালনা করেছেন। উলঝান, যে আগুনে পুড়ি, ক খ গ ঘ ঙ, এরাও মানুষ, ওরা ১১ জন, সংগ্রাম, গুনাই বিবি, অনন্ত প্রেম, বাজিমাত ইত্যাদি সিনেমার কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি।
আলী আকবর রুপু
বরেণ্য সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আলী আকবর রুপু মৃত্যুবরণ করেন ২২ ফেব্রুয়ারি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। অবশেষে হার্ট ও কিডনি জটিলতায় তিনি মারা যান।
১৯৮৪ সালে মালেক আফসারী পরিচালিত ‘রাস্তার ছেলে’ চলচ্চিত্রে গান করে আলোচনায় আসেন আলী আকবর রুপু। বেশি চলচ্চিত্রে কাজ করেননি তিনি। তার সবশেষ সঙ্গীত পরিচালনা ছিল আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘দুই বেয়াইর কীর্তি’ চলচ্চিত্রে। তবে তিনি দেশে-বিদেশে পরিচিতি পেয়েছিলেন হানিফ সংকেতের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে।
আলী আকবর রুপুর সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় আলোচিত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘পদ্ম পাতার পানি নয়’, ‘একদিন কান্নার রোল পড়বে আমার বাড়িতে’, ‘যারে ঘর দিলা সংসার দিলা রে’, ‘সব চাওয়া কাছে পাওয়া’, ‘জানতে চেয়ো না কোন সে বেদনাতে’, ‘বারে বারে পোড়া বাঁশি এত রাতে আর ডেকো না’ ইত্যাদি। এছাড়া তিনি কয়েকটি টিভি চ্যানেলের উদ্বোধনী সঙ্গীত তৈরি করেছেন।
রানী সরকার
চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রানী সরকার বার্ধক্যজনিত কারণে ৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম থেকে অভিনয় করে আসছেন। চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন।
১৯৫৮ সালে মঞ্চনাটকের মাধ্যমে রানী সরকারের অভিনয় জীবন শুরু হয়। ওই বছরই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও’। এরপর ১৯৬২ সালে এহতেশাম পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র ‘চান্দা’তে অভিনয় করেন তিনি। তিনি প্রায় আড়াইশরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- ‘খাঁচা, গ্রাস, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ, অবুঝ বউ, এবাদত, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, আয়না, ঘানি, শ্যাম সাহেব, দেবদাস, রংবাজ, সমাধান, বন্ধন, নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা, বেহুলা, কাঁচের দেয়াল ইত্যাদি।
আইয়ুব বাচ্চু
এ দেশের ব্যান্ডসঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু মারা যান ১৮ অক্টোবর। হার্ট অ্যাটাকের কারণে মগবাজারে নিজ বাসভবন থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৭৮ সালে ব্যান্ড ফিলিংসে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে সঙ্গীতজীবন শুরু করেন। শহীদ মাহমুদ জঙ্গির ‘হারানো বিকেলের গল্প’ গানে প্রথম কণ্ঠ দেন তিনি। এরপর ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা দশ বছর সোলস ব্যান্ডে গান করেন। তার প্রকাশিত প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য অ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘সুখ’, ‘তবুও’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘স্বপ্ন’, ‘আমাদের বিস্ময়’, ‘মন চাইলে মন পাবে’, ‘অচেনা জীবন’, ‘মন আছে নাকি নাই’ ইত্যাদি। ‘সুখ’ অ্যালবামের ‘সুখ’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’ গানগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়া অসংখ্য চলচ্চিত্রে আইয়ুব বাচ্চু প্লে-ব্যাক করেন।
আনোয়ার হোসেন
আলোকচিত্রী ও চলচ্চিত্র গ্রাহক আনোয়ার হোসেনের মরদেহ ১ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার একটি আবাসিক হোটেল থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। ফ্রান্স প্রবাসী আনোয়ার হোসেন একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য ঢাকায় আসেন। আন্তর্জাতিক মানের এই আলোকচিত্রী দেশে প্রচুর কাজ করেছেন। কিন্তু শেষ বয়সে তিনি ফ্রান্সে পরিবারসহ স্থায়ী হন। চিত্রগ্রহণ করে চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তার চিত্রগ্রহণে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- সূর্যদীঘল বাড়ি, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, পুরস্কার, অন্যজীবন, লালসালু ইত্যাদি।
আমজাদ হোসেন
১৪ ডিসেম্বর ৭৬ বছর বয়সে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন আমজাদ হোসেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।
আমজাদ হোসেন ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্রকার, সাহিত্যিক, গীতিকার ও নাট্যনির্মাতা। তিনি একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া তিনি একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ একাধিক রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- আগুন নিয়ে খেলা, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, ভাত দে, গোলাপী এখন ঢাকায়, গোলাপী এখন বিলেতে, সুন্দরী, দুই পয়সার আলতা, জন্ম থেকে জ্বলছি ইত্যাদি। চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি সাহিত্যাঙ্গনেও আমজাদ হোসেনের ছিল সমান পদচারণা। এছাড়া তিনি ছোটদের জন্য অসংখ্য ছড়া, গল্প ও কবিতা লিখেছেন।
সুলতান সেলিম
মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্র অভিনেতা সুলতান সেলিম ১৬ ডিসেম্বর হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৫১ বছর।
সুলতান সেলিমের অভিনয়ে আগমন ১৯৮৯ সালে গ্রুপ থিয়েটারভিত্তিক নাট্যচর্চার মাধ্যমে। তিনি ঢাকা থিয়েটার মঞ্চের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। এ দলের প্রযোজনায় প্রায় ডজনখানেক মঞ্চ নাটকে তিনি কয়েকশ রজনী অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত নাটকের মধ্যে রয়েছে- ঘরজামাই, লাইলী মজনু, কাঠগড়া, সাধারণ গল্প, জন্ডিস, সুন্দর, বীরসা মুন্ডা ইত্যাদি। সেই সঙ্গে তিনি বিজ্ঞাপনচিত্র, নাটক ও চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন।
সাইদুল আনাম টুটুল
সাইদুল আনাম টুটুল ১৮ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি গত ১৫ ডিসেম্বর হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হন। ভর্তির পর থেকে তার অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে আইসিউইতে স্থানান্তর করা হয়।
সাইদুল আনাম টুটুল একাধারে একজন চলচ্চিত্র সম্পাদক, নির্মাতা, নাট্যকার ও অভিনেতা। তিনি ১৯৭৯ সালে ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ সম্পাদকের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি সালাউদ্দিন জাকীর ‘ঘুড্ডি’, শেখ নেয়ামত আলীর ‘দহন’, মোরশেদুল ইসলামের ‘দুখাই’, ‘দীপু নাম্বার টু’র মতো কালজয়ী চলচ্চিত্রগুলো সম্পাদনা করেন। সাইদুল আনাম টুটুল একজন নাট্যনির্মাতাও। তার নির্মিত বহু নাটক রয়েছে, যা বাংলাদেশের টেলিভিশন ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ফিরে আসুন সুস্থ হয়ে...
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সত্তর ও আশির দশকে চলচ্চিত্রে সাড়া জাগানো জনপ্রিয় কমেডিয়ান টেলি সামাদ। ১৯৭৩ সালে পরিচালক নজরুল ইসলামের নির্মিত ‘কার বৌ’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন তিনি। এরপর পাঁচ শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। পঞ্চাশের অধিক চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। নতুন বছরের আগমনে টেলি সামাদ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবেন এটাই প্রত্যাশা সবার।