পরিবহন সেবার ক্ষেত্রে যাত্রী ভোগান্তি যেন অবধারিত। এ খাতের সর্বাধিক সেবাগ্রহীতা শুধু নারী না হলেও সব শ্রেণির যাত্রীর মধ্যে এ খাতে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি এবং হয়রানির শিকার হন। দেশে প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়া নারীর সংখ্যা ২৭ থেকে ৩০ ভাগ। তাদের অধিকাংশেরই যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম গণপরিবহন। আর পাবলিক প্লেসসহ যাতায়াতে এই ২৭ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে যৌন হয়রানির ঘটনা সবচেয়ে বেশি। ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত ‘গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরেন ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি প্রোগ্রামের জেন্ডার স্পেশালিস্ট হোসনে আরা বেগম। যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এ গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, আমরা সমান অধিকারের কথা বললেও সমঅধিকার নীতি এখনো করতে পারিনি। শুধু গণপরিবহন নয়, নারীর চলাচলের সবদিকই আমাদের ভাবতে হবে। আমরা গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার কথা বলছি, একই সঙ্গে রাস্তায় তাদের সম্মান দেওয়ার কথা। সেটি কি আমরা নিশ্চিত করতে পারছি? তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের এই হয়রানিতে যুবকদের থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের সংখ্যাই বেশি। এটি তো আরো ভয়াবহ। পরিবহনে হয়রানির পর শুধু কয়েকটি সংগঠন বা কয়েকজন নারীই প্রতিবাদ করেন, যার ফলে এ প্রতিবাদ খুব একটা জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বিভিন্ন পরিবহন সংস্থা, অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ধর্মীয় সংগঠনগুলো এগিয়ে এলে এ প্রতিবাদ আরো তীব্র হবে, যার ইফেক্ট আমরা সমাজের সর্বত্র দেখতে পাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জোবেদা খাতুন বলেন, ‘আমরা শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা ভুলে গিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। তাছাড়া পরিবহনে ড্রাইভার-হেলপারদের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাপারটা ভয়াবহ হয়। প্রায় প্রতিদিন ড্রাগ নেওয়ার ফলে তাদের একটা সমস্যা থেকেই যায় যেখান থেকে তারা স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। আরেকটি বড় ব্যাপার হলো মেয়েদের কথা না বলা। তারা যদি হয়রানি সম্পর্কে কথা বলেন, তাহলেও অনেক সমস্যার সমাধান হয়। তিনি স্বাভাবিকভাবে পাশের ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ‘সেফটি স্পেস’ তৈরি করে রাখতে পারেন।’ এজন্য কথা বলাটা জরুরি। জোবেদা খাতুন চমৎকারই বলেছেন, এখানে নারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। গাড়িতে পাশাপাশি বসে নারী-পুরুষ যাচ্ছেন, কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছেন না। পুরুষ হয়তো আগবাড়িয়ে কিছু বলছেন না অথচ উশখুশ করছেন কিছু বলার বা জানার জন্য। সেখানে পাশে বসা নারী যদি কথা বলেন, তাহলে পরিবেশটি সহজ ও হালকা হয়।
বিআরটিসির পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী বলেন, আমাদের সব চালককে দুই সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ করানো হয়। নারী, শিশু এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিআরটিসির প্রতিটি বাসে ১৫টি আসন সংরক্ষিত। এছাড়া যাত্রী ওঠানামার ব্যাপারে যাত্রী যদি সচেতন হয়, তবে সমস্যা আরো কমে। আমাদের দুই দরজার বাসের পেছনের দরজাটি শুধু যাত্রী ওঠানোর জন্য এবং সামনেরটি নামার জন্য। অথচ যাত্রীরা দুটি দরজাই ওঠানামার কাজে ব্যবহার করে। এখানে যাত্রীদের সচেতন হওয়া এবং মানসিকতার পরিবর্তন করাটাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই আমরা মনে করি, গাড়িতে ওঠানামার জন্য প্রয়োজনীয় সব জায়গায় নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন। সব মিডিয়ায়ও বিষয়টি প্রচার করা উচিত। রাস্তায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্ট এ ব্যাপারে সাধারণ জনগণকে সচেতন করতে এবং বিষয়টি প্রয়োগ করতে পারেন।
নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার যেসব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, বাস্তবে তার চেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হন নারী। যেসব ঘটনায় মামলা হয় না, সেগুলোর চাপা পড়ে তাকে। আবার মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে মামলা করতেও আগ্রহী হন না। তবে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতা এবং নারীর সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে এখন অনেক নারীই সংকোচ ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন। তারা এখন ঘটনাস্থলেই প্রতিবাদ করতে শিখেছেন। একই সঙ্গে এটিও সত্য যে, গণপরিবহনে নিরাপত্তা এবং অধিকার নিশ্চিত না হওযায় দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর কাঙ্ক্ষিত অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনের যেমন সংশোধন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা।
এ যাবত গণপরিবহনে নারী হয়রানির যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তার জন্য শুধু এককভাবে বা পুরোটাই যে পরিবহন সংশ্লিষ্টরাই দায়ী এমনও নয়। গণপরিবহনে নারীর যৌন হেনস্তার জন্য যাত্রীরাও দায়ী। চোখের সামনে নারী নিগ্রহের ঘটনা দেখলেও অনেক যাত্রী তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিকারে এগিয়ে আসেন না, অর্থাৎ অনেকেই ঝামেলা এড়াতে চান। কাকে কী বলতে গিয়ে নিজেই আবার হেনস্তার শিকার হবেন এ কারণেও অনেকে কিছু বলেন না। আবার সামান্য কারণে কাউকে কিছু বলতে গেলে দেখা যাবে গণরোষের ফলে সেই ব্যক্তিটির বিরাট ক্ষতিও হতে পারে। এসব ভেবে হয়তো যাত্রীরাও কিছু বলেন না। যাত্রীবেশে থাকলেও কে কোন দলের বা কোন ধরনের যাত্রী তা বোঝা যায় না। দেখা যাবে, অপরাধী ব্যক্তিটি শক্তিশালী কোনো দলের সদস্য। পরে যিনি কিছু বলতে যাবেন বা বাধা দিতে যাবেন, তার ওপর নেমে আসতে পারে অযাচিত কোনো ঝামেলা। কাজেই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নও এজন্য অনেকটা দায়ী। কিন্তু তাই বলে কি আমরা বিষয়টি একেবারেই এড়িয়ে যাব এবং দুষ্কৃতিকারীদের ছাড় দিতেই থাকব? সেটা হতে পারে না। নারীদের নিরাপত্তা বিধান করা আমাদের সবার পবিত্র নাগরিক দায়িত্ব।
২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গণপরিবহনে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ৩০ শতাংশ আসন সংরক্ষনের বিধান করা হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয় যে, বড় বাসে নয়টি, মিনিবাসে ছয়টি এবং বিআরটিসি বাসে ১৪টি আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭’র খসড়ায়ও বলা হয়েছিল, গণপরিবহনে নারী, শিশু ও বয়োজেষ্ঠ ও প্রতিবন্ধীদের সংরক্ষিত আসনে তাদের বসতে না দিয়ে অন্য কেউ ওই আসনে বসলে তিনি এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু এটি কি কোথাও মানা হচ্ছে? অনেক সময় বাসের হেল্পাররা বলেন, ‘মহিলা সিট খালি নেই।’ সকালে এবং অফিস ছুটির পর নারীরা যেন কোনোভাবেই গণপরিবহনে উঠতে পারছেন না, রীতিমতো যুদ্ধ করে উঠতে হচ্ছে গাড়িতে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাবে রাজধানীতে ২০১৮ সালের মাচ পর্যন্ত নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ২৮ হাজার ২২২। আর রাজধানীর বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন সাত হাজার বাস চলে, এর মধ্যে সরকারি পরিবহন বিআরটিসির বাস ৪০০টি। কিন্তু নারীদের জন্য বাস আছে মাত্র ১৫টি। সেটিও সরকারি পরিবহন সেবা বিআরটিসির। তাই প্রতি বাসে বা বাসস্টপ থেকে শহরের প্রধান প্রধান সড়কে চলা প্রতি পাঁচটি বাসের অন্তত একটি বাস নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার পাশাপাশি অন্য সব বাসে নারীদের জন্য কমপক্ষে ২০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান করা উচিত। এ ২০ শতাংশের অন্তত অর্ধেক আসন নারীদের জন্য সবসময় সংরক্ষিত রাখতে হবে, যেখানে পুরুষদের বসা একেবারেই নিষিদ্ধ থাকবে। সংরক্ষিত বাকি অর্ধেক আসনের কোনো আসন যদি খালি থাকে, তাহলেই শুধু পুরুষ যাত্রী ওইসব আসনে বসতে পারবেন। তবে কোনো নারী যাত্রী বাসে ওঠামাত্র তাকে সেখানে বসতে দিতে হবে। এই অভ্যাসটুকু পুরুষদের করতে হবে। এজন্য রেডিও, টেলিভিশন, প্রিন্ট মিডিয়া, ট্রাফিক পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক সবাইকে কাজ করতে হবে।
গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়, সেমিনার হয় কিন্তু এ ধরনের ঘটনাগুলো কিছুতেই যেন রোধ হচ্ছে না। কিন্তু রোধ আমাদের করতেই হবে। নারী কোনোভাবেই যাতে রাস্তায়, স্টেশনে কিংবা কোনো পরিবহনে কোনো ধরনের হেনস্তার শিকার না হন, সেজন্য যাত্রী, অযাত্রী, সাধারণ মানুষ, শিক্ষক, ছাত্র, পুলিশ সবাইকে অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে সর্বত্র। নারীবান্ধব সমাজ ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ আমাদের এই সোনার দেশটিকে কোনোভাবেই আমরা অসভ্য দেশ বানাতে চাই না।
লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত