বিশ্লেষণ

খেলাপিদের পুরস্কার আর হিসাব তলবের বছর

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

বছরটি শুরু হয়েছিল নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দায়িত্ব নিয়েই বেশ কিছু কথা বলেন তুখোড় এই হিসাববিদ। স্বভাবতই জনগণের প্রত্যাশা ছিল, ব্যাংক খাত হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে। তবে বছর শেষে অর্জন খুব বেশি নেই। বরং ঋণখেলাপিদের পুরস্কৃত করার বছর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ২০১৯ সাল। 

বছরজুড়ে সংকটের আবর্তেই ছিল দেশের ব্যাংক খাত। ব্যাংক খাতের সংকট আরো বেড়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি চেষ্টার মধ্যে প্রতি মাসেই কমেছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি। ব্যাংক খাতের অর্থসংকটের মধ্যেও ব্যাপক হারে ঋণ নিয়েছে সরকার। সুদহার চাপানোর খেলা ছিল বছরের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত। তবে ব্যাংক খাতের জন্য ইতিবাচক ছিল রেমিট্যান্সে নজরকাড়া প্রবৃদ্ধি। যদিও রেমিট্যান্সের হাওয়া রপ্তানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক বাণিজ্যে পাল তুলতে পারেনি।

খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না— অর্থমন্ত্রীর এমন ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু ২০১৯ সাল। এই খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য খেলাপি নীতিমালা সহজ, অবলোপন নীতিমালা শিথিলসহ ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করা হয়। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ অবলোপন এবং পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নবায়ন করা হয়েছে। এরপরও মাত্র ৯ মাসে খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ৯ মাসে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৯ কোটি টাকা। এই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ হারে। এটি ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রায় আড়াইগুণ।

বেসরকারি বিনিয়োগ চাঙা করে রেকর্ড পরিমাণ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায় সরকার। এই লক্ষ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়। ওই বাজেটের লক্ষ্য অর্জনে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। সরকারি খাতে ব্যাংকগুলোকে ঋণ বাড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়া হয় ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। সরকারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই লক্ষ্যমাত্রা ওলট-পালট হয়ে গেছে। বিনিয়োগ চাঙা করার জন্য সুদহার কমানোর চেষ্টা ছিল বছরজুড়ে; কিন্তু তা কমেনি। সুদহার কমানোর ভয়ে ঋণ বিতরণই কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। অবশ্য অনেক ব্যাংকের কাছে ঋণ বিতরণের মতো অর্থই ছিল না। গত কয়েক মাসে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধির ১০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ হয়েছে। আগের মাস সেপ্টেম্বর ছিল ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে। এই প্রবৃদ্ধির হার গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ লাগামহীনভাবে বাড়ছে বলে ব্যাংকগুলোয় বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হচ্ছে। অনেক ব্যাংক এটি নির্ধারিত পরিমাণ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ফলে ব্যাংকগুলোর কাছে ছিল না পর্যাপ্ত নগদ অর্থ। বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার এটি একটি অন্যতম কারণ। এ ছাড়া আর্থিক খাতের নানা কেলেঙ্কারি ও সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি হওয়ায় ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ফলে একদিকে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে উচ্চ সুদহারের কারণে ঋণ নিতেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা। সব মিলিয়ে বেসরকারি ঋণ প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি। যে হারে বাড়ছে তা মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।

এদিকে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া এবং খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ হিসাবে উচ্চ ঋণের সুদহারকে দায়ী করছেন সরকার। ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে গত ১ ডিসেম্বর (রবিবার) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের নির্দেশনায় সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদন দাখিলের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেন, আগামীকাল থেকে (১ জানুয়ারি) থেকে ব্যাংকগুলোয় সুদের হার এক অঙ্ক (১০ শতাংশের নিচে) কার্যকর হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারির কাজ করছে। 

বছরজুড়ে ব্যাংক খাতের সংকটকে প্রকট করেছে সরকারের ঋণের বাড়তি চাপ। বেসরকারি ঋণ কমলেও হু হু করে বাড়ছে সরকারি ঋণ। চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় শতভাগ। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ বা ধার নেওয়ার লক্ষ্য ধরে সরকার।

সংকটের বছর হিসেবে পরিচিতি চলতি বছরে ব্যাংক খাতের আরেকটি সমালোচনার বড় জায়গা হলো নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন। ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের বিরোধিতার সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয় নতুন তিন ব্যাংকের অনুমোদন। ব্যাংকগুলো হলো— বেঙ্গল কমার্শিয়াল, পিপলস ও সিটিজেন ব্যাংক। প্রাথমিকভাবে আগ্রহপত্র বা লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) পাওয়ার পরও শর্ত অনুযায়ী পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহসহ বিভিন্ন নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হওয়ায় এখনো চূড়ান্ত লাইসেন্স পায়নি এসব ব্যাংক। তবে চলতি বছর কার্যক্রম চালু করেছে পুলিশের মালিকানাধীন কমিউনিটি ব্যাংক। ব্যাংকটি গত বছর অনুমোদন পেয়েছিল। নতুন ব্যাংক অনুমোদনের বছরে ভালো ছিল না দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান অর্থ সংকটে ভুগছে। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের অভিযোগে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসকে (পিএলএফএসএল) প্রথমবারের মতো অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ১৪ জুলাই পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অর্থনীতির অন্যান্য সূচক নেতিবাচক হলেও সুবাতাস বয়েছে রেমিট্যান্সের পালে। রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা এবং টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে বৈধ পথে বেড়েছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭১ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। গত বছর একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৬২৯ কোটি ডলার। কিন্তু অস্থির ডলারের বাজার। সংকটের কারণে হুহু করে বেড়েছে ডলারের দাম। অন্যদিকে দুর্বল হয়েছে টাকার মান। বছরের প্রথম আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর নির্ধারণ ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। অর্থাৎ পণ্য আমদানিতে প্রতি ডলারে ব্যয় করতে হয় ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। চলতি বছরে দফায় দফায় দাম বেড়ে ডলার ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা দাঁড়িয়েছে।

২০১৯ সালের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। গত সেপ্টেম্বরে এই অভিযান শুরুর পর ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের পাঁচ শতাধিক হিসাব তলব ও জব্দ করা হয়। এ তালিকায় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন। হিসাব জব্দ করা ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী শেখ সুলতানা রেখা, ছেলে আবিদ চৌধুরী, মুক্তাদির চৌধুরী, ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী, লেক ভিউ প্রপার্টিজ, আরএও কনস্ট্রাকশন, আজিজ মোহাম্মদ ভাই, অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধান, যুবলীগের জি কে শামীম, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদ, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজীব, ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান, কৃষক লীগ নেতা ও কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ, যুবলীগ দক্ষিণের সহসভাপতি এনামুল হক আরমান, যুবলীগের বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান আনিস, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের আবুল কালাম এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। আরো কিছু ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, নজরুল ইসলাম বাবু, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads