জাতীয়

সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চান শিক্ষাবিদরা

খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান!

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ২৪ অগাস্ট, ২০২১

করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ ১৭ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যদিও এই সময়ে খুলে দেওয়া হয়েছে সবকিছুই, কিন্তু একদিনের জন্যও খোলা হয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন মহল থেকে অনেকদিন ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর জোর দাবি উঠেছে। অবশেষে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী সেপ্টেম্বর থেকে ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গণমাধ্যমকে গত ১৬ আগস্ট এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি গ্রহণের কথা জানান। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে খুলে দেওয়ার কথাও জানান তিনি। তবে ঠিক কবে নাগাদ খুলে দেওয়া হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি শিক্ষামন্ত্রী। পাশাপাশি সংক্রমণ একেবারে কমে গেলে সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক থেকে শুরু করে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কথাও জানান তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা কার্যক্রম চালুর বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আজ এ বিষয়ে বৈঠক করার কথা রয়েছে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘মঙ্গলবার প্রভোস্ট কমিটির সভায় বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়ে সার্বিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। হল প্রভোস্টদের সঙ্গে হলগুলোর সার্বিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করে সেই আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা চিন্তা করা হবে।’

অন্যদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (গণভবন থেকে অনলাইনে যুক্ত হন) সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরাও যুক্ত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে প্রোগ্রাম ঠিক করছে। কবে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে তা শিগগির ঘোষণা দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি। এদিকে, সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর বিষয়ে সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন, শিক্ষামন্ত্রী ড. দিপু মনি। যদিও কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে চালু করা হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ প্রকাশ করছে না সরকার। মন্ত্রী কেবল সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর নভেম্বরে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর বিষয়টি করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে বলেও জানান তিনি।

মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি আবারো খারাপ হলে এভাবেই মাসের পর মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে? নাকি ভিন্ন কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা চালু রাখা হবে, সে বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখা নেই। সেইসঙ্গে, সংক্রমণ বাড়লে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো পরীক্ষাও বন্ধ করে দেওয়া হবে কিনা সেটিও খোলাসা করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে ইউনিসেফের গাইডলাইন মেনে চলা হবে। কিন্তু সরকারের এই পরিকল্পনা কেবলমাত্র পরীক্ষাভিত্তিক। তাতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস ও লেখা পড়া চালু রাখার বিষয়ে কোনো রূপরেখা নেই। একইসাথে, যেসব শিক্ষার্থী একটিমাত্র পরীক্ষা, অ্যাসেসমেন্ট কিংবা শুধুমাত্র রেজাল্ট না হওয়ার মতো ছোটখাটো কিছু বিষয়ের কারণে তাদের পরবর্তী শিক্ষা অথবা কর্মজীবনের প্রবেশের সুযোগ আটকে আছে সেগুলো নিয়েও কোনো ধরনের বার্তা দেননি শিক্ষামন্ত্রী। এনিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এমনকি শিক্ষাবিদদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ এবং অসন্তোষ দানা বাঁধছে।  

শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর বিষয়ে সরকারকে আরো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সরকারের নীতি নির্ধারকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে এক ধরনের অনীহার মধ্যে আটকে আছেন। স্কুল খোলা হবে কিনা সেটা একধরনের বড় সিদ্ধান্ত। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীর জীবন সামান্য কারণে থমকে আছে। সেগুলো নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন হচ্ছে না। শিক্ষা সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত হিমাগারে রেখে দেওয়া হয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘গত বছরের জুলাই- আগস্টের দিকে করোনা কমে গিয়েছিল, তখন কিন্তু পরীক্ষা নেওয়া যেতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে। ক্লাস চালানো যেত পরিকল্পনা করে। আমরা শুধু পরীক্ষা নিয়ে কথা শুনেছি, কিন্তু পড়াশুনার কী হবে তা নিয়ে কোনো উদ্বেগ বা পরিকল্পনা দেখিনি। না পড়িয়ে পরীক্ষা নিয়ে কী হবে? এই নিয়ে কোনো রোডম্যাপ বা টাইম লাইন আমাদের নেই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এর মতে, বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত খুলে দেওয়া উচিত। তার মতে, যেসব এলাকায় সংক্রমণের হার কম সেসব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে একযোগে সব প্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষায় সেগুলোকে বন্ধ রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশের খবরকে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘শিক্ষাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। একটির জন্য আরেকটির অপেক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, দেশের শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।’

এদিকে, টানা প্রায় দেড় বছর ধরে লেখাপড়া বন্ধ থাকায় কিশোর ও তরুণ শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এনিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগের সীমা পরিসীমা নেই। কিন্ডারগার্টেন কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট ছোট কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঘরবন্দি নামকাওয়াস্তে পড়ালেখার ফাঁকে মোবাইল ফোন আসক্তি কিংবা ভিডিও গেমের নেশায় বুঁদ হওয়া নিয়েও উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীদের বাইরে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো-বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকই বেকার হয়ে পড়েছেন। এছাড়া, বইখাতাসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের ব্যবসায়ীরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতির শিক্ষার হচ্ছেন। সবমিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতিই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি, অভিভাবকদের অব্যাহত উদ্বেগ আর এই খাতের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য মানুষের রুটি-রুজির বিষয়টিও।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads