মো. শাহাদৎ হোসেন শাহ্, দিনাজপুর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’-এর সফলতার বাস্তব স্বাক্ষর প্রতিফলিত হয়েছে দিনাজপুর সদর উপজেলার ১ নং চেহেলগাজী ইউনিয়নের নশিপুর গ্রামের আসমা বেগম লাইলীর নার্সারি, গাভি, ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালনের মধ্য দিয়ে। দিনাজপুর শহর থেকে ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরে হাইওয়ে থেকে ১ কিলোমিটার ভেতরে সদর উপজেলার ১ নং চেহেলগাজী ইউনিয়নের নশিপুর গ্রাম। ওই গ্রামের কৃষক আজগার আলীর চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার বড় আসমা বেগম লাইলী (৩০)। ২০০৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় সে বছরই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর একটি সুখী দাম্পত্য জীবন আশা করলেও তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে নানা চড়াই-উতরাই। সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য লাইলী ও তার স্বামী মাহবুব একটি এনজিওতে চাকরি নেয়। কিন্তু ৬ মাস পরে তারা বুঝতে পারেন এটি ভুুয়া প্রতিষ্ঠান। এরপর কাপড়ের ব্যবসা শুরু করলেন। তাতেও তেমন আয়ের মুখ দেখতে পেলেন না। এ অবস্থায় প্রথমে চট্টগ্রাম এবং পরে সিলেটে শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। সবশেষ ২০১০ সালে তার ওপর নেমে এলো অন্তিম বিপর্যয়টি। দাম্পত্য কলহ তো ছিলই, তার সঙ্গে যুক্ত হয় যৌতুকের জন্য নানা ধরনের অত্যাচার। একপর্যায়ে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ের পর দুই শিশুসন্তানসহ লাইলীকে বের করে দেয়। বাবার বাড়িতে থেকেই দুই সন্তানকে নিয়ে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
লাইলী জানান, বর্তমানে তার জীবনে সফলতা এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের স্বল্প সুদে ঋণের টাকা নিয়ে। ওই ঋণের টাকায় গাভি, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন ও নার্সারির ব্যবসা করে তিনি এখন একজন সফল খামারি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে নশিপুর গ্রামে ৬০ জন পুরুষ-মহিলা সদস্যের সমন্বয়ে ‘নশিপুর গ্রাম উন্নয়ন সমিতি’ গঠন করে দেন একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাঠ সহকারী স্নিগ্ধা রানী রায়। ৬০ সদস্যের সমিতির প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা করে মোট ৩ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণ দেয় সদর উপজেলা ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প।
লাইলী মাত্র ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ২টি ছাগল কেনে। ওই ২টি ছাগল সাড়ে পাঁচ মাস প্রতিপালন করে ১৩ হাজার ৯৮০ টাকায় বিক্রি করেন। বিক্রির টাকা থেকে ঋণের আসল ৫ হাজার ও ২০০ টাকা সুদসহ ৫ হাজার ২০০ টাকা ঋণ পরিশোধ করেন। এরপর ২০১৪ সালের জুনে পুনরায় তাকে ১০ হাজার টাকা ঋণ দেয় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প। এই ঋণের টাকায় তিনি ১০ হাজার আমের বিচি কেনেন ১ হাজার টাকায়। শুরু হয় লাইলীর নতুন নার্সারির ব্যবসা। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে নার্সারির কাজ পরিচর্যার জন্য তিনি তিন দিনের প্রশিক্ষণ নেন উপজেলা হটিকালচার কার্যালয় থেকে। ওই প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে ৫ হাজার টব ৬ মাস পরিচর্যা করে প্রতিটি টবের চারা ২০ থেকে ২৫ টাকা করে পাইকারিতে শহরের নার্সারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। টবের চারা বিক্রি করে তিনি ৫০ হাজার টাকা মুনাফা করতে সক্ষম হন। ওই বছর থেকেই তার নার্সারি ব্যবসা সফল হতে শুরু করে। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ওই টাকা দিয়ে ২টি গাভি ও ২টি ছাগল এবং ১০টি হাঁস ও ১০টি মুরগি কিনে নিজ বাড়িতেই ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের সফল কার্যক্রম শুরু করেন।
লাইলীর নার্সারিতে এখন ১০ হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের ফল ও ফুল গাছ রয়েছে। বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। তার নার্সারির সফলতা দেখে গ্রামের অন্যান্য পরিবার এই ব্যবসা শুরু করে। সব মিলিয়ে তার বাড়িটি এখন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’-এ পরিণত হয়েছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের উপজেলা সমন্বয়কারী মৌসুমী আক্তার, জেলার কর্মকর্তা উপ-পরিচালক রেজিনা আক্তার তার বাড়ি ও খামার পরিদর্শন করে এ বছর তাকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ মঞ্জুর করেন। তাকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রকল্প কর্মকর্তারা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সমিতির অন্য সদস্যদেরও নার্সারি এবং গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। তার নার্সারি ব্যবসা ওই এলাকায় এখন ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে।
লাইলীর বড় ছেলে আশরাফুল ইসলাম আকাশ (১২) ষষ্ঠ শ্রেণিতে নশিপুর হাইস্কুলে ও মেয়ে মেহের নিগার ময়না (১০) নশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা ও নিজের সংসার প্রতিপালনের জন্য কারো কাছে সাহায্য চাইতে হয় না। খামারের কাজে সহায়তা করেন তার বাবা আজগার আলী ও মা লতিফা বেগম।
একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের দিনাজপুর জেলা সমন্বয়কারী বিআরডিবির উপ-পরিচালক রেজিনা আক্তার বলেন, দিনাজপুর জেলার ১৩টি উপজেলার ১০২টি ইউনিয়নে ১ হাজার ৫৬৭টি একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের উন্নয়ন সমিতি রয়েছে। সব মিলিয়ে আসমা বেগম লাইলী এখন এলাকার তথা দিনাজপুরের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে পেরেছেন। তার অনুপ্রেরণায় এলাকার অসংখ্য বেকার চাকরির খোঁজ না করে লাইলীর মতো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।