ধর্ম

খাদ্য গ্রহণে ইসলামের নির্দেশনা

  • প্রকাশিত ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০

মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান

 

 

মানবদেহে শক্তির উৎস হলো খাদ্য। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের অতীব প্রয়োজনীয় দুটো বিষয় হলো সুস্থদেহ ও সুস্থপ্রাণ। খাদ্য হলো দেহ-মন সুস্থ ও সতেজ রাখার প্রধান উপকরণ। খাদ্যের অভাবে শরীর দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। যেসব আহার্যসামগ্রী গ্রহণ করলে জীবদেহের বৃদ্ধি, পুষ্টি, শক্তি উৎপাদন ও ক্ষয়পূরণ হয় সর্বোপরি শরীর বৃত্তীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে খাদ্য বলে। পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামে সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের জন্য এবং রোগ মুক্ত থাকার জন্য খাবারের সু-শৃঙ্খল নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে।

খাবার গ্রহণের পূর্বে হাত  ধোয়া : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। তাই মুমিন সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকেন। দৈহিক পরিচ্ছন্নতা হলো হাত, মুখ, দাঁত ইত্যাদি পরিচ্ছন্ন রাখা। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পানাহারের আগে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নিতেন। (মুসনাদে আহমদ) হজরত সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি তাওরাতে পড়েছি যে, খাবারের বরকত হলো খাওয়ার শেষে ওজু (উভয় হাত ধৌত) করা। আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা ব্যক্ত করলে তিনি বলেন, খাবারের বরকত হলো খাবারের আগে ও পরে ওজু (উভয় হাত ধৌত) করা। (তিরমিযি, মেশকাত, হাদিস নং-৪৬০৪)

আল্লাহর নাম নিয়ে ডান হাতে খাওয়া : রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা জীবন ডান হাতে খাবার খেয়েছেন ও বাম হাতে খেতে নিষেধ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা বাম হাত দ্বারা খাবার খাবে না ও পান করবে না। কেননা, শয়তান বাম হাতে খায় ও পান করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২০২২) হজরত উমর ইবনে আবু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি একটি বালক হিসেবে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তত্ত্বাবধানে ছিলাম। খাবার পাত্রে আমার হাত এক জায়গায় স্থির থাকত না। তাই তিনি আমাকে বললেন, হে বালক! আল্লাহর নাম দিয়ে নিজের ডান হাত দিয়ে সামনে থেকে খাও। এরপর থেকে আমি ওইভাবেই খেয়ে থাকি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৩৭৬)

 

খাওয়ার সময় হেলান দিয়ে না বসা : রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত বিনয়ী হয়ে খাবার খেতে বসতেন। তিনি হেলান দিয়ে ও উপুড় হয়ে পেটের ওপর ভর করে বসে খেতে নিষেধ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি হেলান দিয়ে খাবার গ্রহণ করি না।’ (সহিহ বুখারি) হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আহারের সময় হাঁটু উঁচু করে বসতেন এবং হেলান দিয়ে বসতেন না।

তিন আঙুল দিয়ে খাবার গ্রহণ করা : খাবার গ্রহণ করার সময় বড় বড় গ্রাস গ্রহণ করা অভদ্রতার পরিচায়ক। হজরত কাব ইবনে উজরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনি আঙুল অর্থাৎ বৃদ্ধাঙ্গুলি, তর্জনি ও মধ্যমা আঙুলের সাহায্যে আহার করতে দেখেছি। হজরত মোল্লা আলী কারী (র.) বলেন, পাঁচ আঙুল দ্বারা আহার করা লোভী ব্যক্তির আলামত।

খাবার শেষে আঙুল ও প্লেট চেঁটে খাওয়া : রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ খাবার খাবে আঙুল চেঁটে না খেয়ে হাত মুছবে না। কেননা, সে জানেনা যে, কোন খাবারে বরকত আছে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৩২৭০)

বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে : হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যখন তোমরা খাবার খেতে শুরু কর তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করো। আর যদি আল্লাহর নাম স্মরণ করতে ভুলে যাও, তাহলো বলো-বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু।’    (তিরমিযি, হাদিস নং-১৮৫৮)

দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়া : হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো ‘সুকুরজা’ অথার্ৎ ছোট পাত্রে আহার করেছে, তার জন্য কখনো নরম রুটি বানানো হয়েছে কিংবা তিনি কখনো টেবিলের ওপর আহার করেছেন বলে আমি জানিনা। কাতাদাহকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তাহলে তিনি কীসের ওপর আহার করতেন? তিনি বললেন, চামড়ার দস্তরখানের ওপর।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৩৮৬, জামে তিরমিযি, হাদিস নং-১৭৮৮) হজরত হাসান ইবনে মিহরান আল কিরমানী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবি হজরত ফারকাদ (রা.)কে বলতে শুনেছি, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করেছি এবং তার দস্তরখানে একত্রে বসে আহার করেছি।’ (আখলাকুন্নবী (সা.), পৃষ্ঠা-৩০১)

খাদ্যদ্রব্যের দোষত্রুটি না ধরা : সবপ্রকার খাবার আল্লাহপ্রদত্ত রিজিক। খাদ্যের ত্রুটি বা দোষ খোঁজার অর্থ হলো আল্লাহপ্রদত্ত রিজিকের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো খাদ্যদ্রব্যের দোষত্রুটি বর্ণনা করতেন না। [কোনো খাদ্য রুচি হলে খেতেন অন্যথায় বর্জন করতেন]। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৩৩৮২)

মুমিন ব্যক্তি স্বল্প আহারে অভ্যস্ত থাকেন : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি অধিক পরিমাণ খেত, পরে সে ইসলাম গ্রহণ করল এবং কম খাওয়া শুরু করল। বিষয়টি রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আলোচিত হলে, তিনি বলেন, মুমিন এক আঁতে খায় আর কাফের সাত আঁতে খায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এর অপর বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুজনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট। আর তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৩৯২)

ফুঁ দিয়ে খাবার গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা : ইসলামের মধ্যে গরম খাবারে ফুঁ দিয়ে খাওয়া নিষেধ করা হয়েছে এবং পানির মধ্যে কোনো ময়লা পড়লেও ফুঁ দিয়ে পান করা যাবে না। এতে নিজের ছড়ানো কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস মিলিত হতে পারে। যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যখন কেউ কোনো কিছু পান করবে তখন সে যেন পান-পাত্রে ফুঁ না দেয় অথবা নিঃশাস না ছাড়ে।’ (বুখারি, হাদিস নং-৫৬৩০, মুসলিম, হাদিস নং- ২৬৭) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ভাপ চলে না যাওয়া পর্যন্ত কোনো খাবার গ্রহণ করা উচিত নয়।

একত্রে খাবার গ্রহণ করা : একত্রে খাবার গ্রহণ করলে খাবারে বরকত হয়। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা একসাথে খাও পৃথক পৃথক খেয়ো না। একজনের খাবার দুইজনের জন্য যথেষ্ট।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৩২৮৬) একদা একজন সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা খাদ্য গ্রহণ করি কিন্তু পরিতৃপ্ত হইনা। তিনি বললেন, সম্ভবত তোমরা একা একা খাও, তারা বললেন, জি হ্যাঁ। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা খাবার গ্রহণে এক সাথে বস এবং আল্লাহর নাম নাও। তাহলে তোমাদের খাবারে বরকত হবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-১৫৬৪৮)

খাদ্যাংশ পড়ে গেলে তা ধুয়ে খাওয়া : রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কারো খাবারের লোকমা হাত থেকে পড়ে গেলে তার ময়লা দূর করে সে যেন তা খেয়ে ফেলে এবং শয়তানের জন্য তা ছেড়ে না দেয়। খাবার শেষে সে যেন আঙুলগুলো চেঁটে খায়। কারণ তোমরা জাননা, কোন খাবারে বরকত নিহিত আছে।’ (মুসলিম, হাদিস নং- ২০৩৪, আহমাদ, হাদিস নং-১৪২১৮)

খাবার শেষে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা : আল্লাহতায়ালা অপার নেয়ামতসমূহের মধ্যে একটি হলো ক্ষুধা পেলে খাদ্য গ্রহণের ব্যবস্থা করা। তিনি পৃথিবীতে খাদ্য হিসেবে নানা ফলমূল, শস্যবীজ সৃষ্টি করেছেন। তাই ক্ষুধা নিবারণ হলে কর্তব্য হলো আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদ্য গ্রহণ শেষে শুকরিয়া আদায় করতেন। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাবার গ্রহণ শেষে বলতেন-‘আলহামদুলিল্লাহ হামদান কাসিরান তায়্যিবান মুবারাকান ফিহি, গায়রা মাকফিইন, ওয়া মুয়াদ্দায়িন, ওয়ালা মুসতগনা আনহু রাব্বানা’। অর্থ: পবিত্র, বরকতময় অনেক অনেক প্রশংসা আল্লাহর জন্য, হে আমাদের প্রতিপালক যে খাদ্য হতে নির্লিপ্ত হতে পারবনা, তা কখনো চিরতরে বিদায় দিতে পারবনা, আর তা হতে অমুখাপেক্ষীও না। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৪৫৮) অথবা, ‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আতআমানা, ওয়াসাকানা, ওয়াজাআলানা মিনাল মুসলিমিন’। অর্থ : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের খাইয়েছেন, পান করিয়েছেন এবং মুসলিম বানিয়েছেন। (আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৮৫২)

 

লেখক : সহকারী শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads