রবিউল ইসলাম
এই সরকারের আমলে সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। পাশাপাশি মঙ্গা বিদায় নিয়েছে এ দেশ থেকে। কিন্তু বর্তমান করোনায় আবার চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়েছেন অনেক মানুষও। বেতন বকেয়া রেখে, অর্ধেক বেতনেও কাজ করতে হচ্ছে অনেককে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে উপর্যুপরি। খরচ বেড়েছে জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রে। একক রোজগার দিয়ে বর্তমান অবস্থায় সংসার চালানো কষ্টকর।
দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বাড়ানোয় সরাসরি এর প্রভাব পড়েছে পরিবারের ব্যয়ে। এ কারণে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন দ্রব্যমূল্য বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গড়পড়তা আয়ের মানুষেরা।
সংসারের অন্য খরচের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রের খরচ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচের চাইতে কয়েকগুণ বেড়েছে প্রাইভেট, কোচিংয়ের খরচ। সত্তর, আশির দশকে এই ক্ষেত্রে এতটা খরচ করতে হয়নি। সরকার বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের নতুন বই দিয়েছেন এ কথা সত্য এবং তার জন্য সরকার ধন্যবাদ পেতেই পারে। কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়াতে এবং অন্যান্য কারণে শিক্ষার্থীদের নোট গাইড কিনতে হচ্ছে বিপুল দামে। এই ক্ষেত্রে অভিভাবকরা চাপে আছে প্রচণ্ড। একটি পরিবারে দুইটি শিক্ষার্থী থাকলে ওই পরিবারের অভিভাবককে গুনে গুনে প্রতি মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে ওই দুটি শিক্ষার্থীর পেছনে। অভিভাবকরা শত কষ্ট বুকে চেপে ধার-দেনা করে হলেও এক্ষেত্রে কেউ পিছু হটে না। নিজে শিক্ষিত না হলেও এ দেশের মানুষ তার সন্তানকে নানা কষ্টে শিক্ষিত করতে চায়।
দুই সন্তান নিয়ে স্বামী-স্ত্রী চাকরি করেও ভাড়া বাসায় থেকেও কষ্টে হিমশিম খাচ্ছে অনেকে। কারণ সব খাতেই ব্যয় বেড়েছে, আয় সেভাবে বাড়ছে না। ফলে অনেকে বাড়তি খরচ মেটাতে চাকরির পাশাপাশি পার্টটাইম জব, আউট সোর্সিং ইত্যাদির দিকে ঝুঁকছে। খরচের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে মুঠোফোনের খরচ। এ দেশে প্রায় পরিবারে নানা বয়সের মানুষের জন্য মুঠোফোন আছে এবং তা একাধিক। অনান্য ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে কিন্তু অনেক মানুষের মোবাইল, ফেসবুক, টিভি সিরিয়াল এখন নিত্যসঙ্গী। তাতে যা খরচ হওয়ার হোক। ফলে প্রতিটি সংসারে বাড়তি খরচ হিসেবে যুক্ত হয়েছে এ খরচটি।
বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি পরিবারে স্থির ব্যয় বেড়েছে মূলত বাসা ভাড়া, সন্তানের শিক্ষার খরচ, পরিবহন ব্যয় এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাবদ। অদ্ভুদ লাগে এসব ক্ষেত্রে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যার যা খুশি করে যাচ্ছে, আবার কোনো কোনো বাজার সিন্ডিকেট এক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়ছে। কেব্ল টেলিভিশনের (ডিশ) সংযোগ ফি, গৃহকর্মীর মজুরি, এমনকি ময়লা ফেলার জন্যও বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই এসব ব্যয় মেটাতে হয় পরিবারকে। এ ক্ষেত্রে সাশ্রয়ের কোনো সুযোগ নেই।
আর এখন কাঁচাবাজার, মাছের বাজার, মাংসের বাজার, ভোজ্যতেলের বাজারে যারা নিত্যদিন যান, তারা অতিরিক্ত ব্যয়টা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন বোধ করি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস আ্য্যসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) হিসেবে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৭১ শতাংশ। ক্যাবের এই হিসাব ১১৪টি খাদ্যপণ্যে, ১৪টি সেবার তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি। এতে শিক্ষা, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
ক্যাব বলছে রাজধানীসহ প্রতিটি বড় বড় শহরে ২০০৯ সালে দুই শয়ন কক্ষ বা বেডরুমের একটি পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১০ হাজার ৮০০ টাকা, ২০১৬ সালে তা ১৯ হাজার ৭০০ টাকায় উঠেছে। আলোচ্য সময়ে এক ইউনিট বিদ্যুতের দাম ছিল ৯৩ শতাংশ, পানির দাম ৫৬ শতাংশ এবং প্রতি কিলোমিটার বাসা ভাড়া ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। ব্যয় বাড়তে থাকায় ব্যয়বহুল নগরী হয়ে উঠেছে ঢাকাসহ অন্য শহরগুলো। অন্যদিকে গ্রামীণ জীবনও কঠিন হয়ে উঠেছে ব্যয় বৃদ্ধির চাপে।
যুত্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীর তালিকার শীর্ষ শহর এখন ঢাকা। ‘কষ্ট অব লিভিং সার্ভে’ শীর্ষক এ জরিপ খাবার, পোশাক, বাড়িভাড়া, গৃহস্থালি পণ্য সেবার দাম বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়। জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের মোট ১৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৬২তম।
ব্যয় বৃদ্ধির চাপে দেশের মানুষ এখন আগের চেয়ে কম পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করতে পারছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। বিপরীতে খরচ ছিল ১১ হাজার ২০০ টাকা। ফলে সাশ্রয় হতো ২৭৯ টাকা। ২০১৬ সালে একটি পরিবার সাশ্রয় করতে পারছে ২৩০ টাকা। আলোচ্য বছরে একটি পরিবারের গড় আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা এবং ব্যয় ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা।
গ্রামের মানুষ আছেন আরো বিপাকে। ২০১০ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গিয়েছিল, তাদের গড় আয়ের পরিমাণ মোট ব্যয়ের চেয়ে বেশি। তারা মাসে ৩৬ টাকা সাশ্রয় করতে পারতেন। ২০১৬ সালে দেখা যাচ্ছে তাদের মাসিক ব্যয় আয়ের চেয়ে ২৮৮ টাকা বেশি।
বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, পরিস্থিতি প্রকাশের সবচেয়ে ভালো সূচক ভোক্তা মূল্য সূচক। আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এতে বড় আঘাত আসে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। দারিদ্র্যসীমার নিচের দিকে থাকা ২০ শতাংশ মানুষের দৈনিক খরচের ৪০ শতাংশ ব্যয় হয় চালের পেছনে। এ ক্ষেত্রে চালের মূল্য ১০ টাকা বৃদ্ধি মানে দরিদ্র মানুষের আয় ৪ টাকা কমে যাওয়া। আর বর্তমান করোনা পরিস্থিতি উক্ত সব হিসাবকে প্রশ্নে মুখে দাঁড় করিয়েছে নিঃসন্দেহে।
মানুষকে সচেতন হতে হবে পণ্যে কেনার ক্ষেত্রে। পণ্যের দাম অস্বাভাবিক লাগলে একজন ক্রেতা ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাতে পারেন। বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। সরকারের সেবা সংগঠনগুলোকে মানুষের সেবায় এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক