কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় বর্ষবরণ হলো আমাদের অতি প্রাচীনতম উৎসব। পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। এক হাজার চারশ সাতাশ বছর ধরে বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নববর্ষের ঐতিহ্য লালিত হয়ে আসছে। বাংলা বর্ষবরণে বিভিন্ন উৎসব ও আনন্দ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফুটে ওঠে গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ।
মোগল আমলেরও আগে অতি প্রাচীন বাংলায় শত শত বছর ধরে মূল জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষও বর্ষবরণ করে আসছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। জাতীয়ভাবে বাংলা সনের প্রথম দিন তথা পহেলা বৈশাখ পালন করা হলেও বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে একসাথে ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত বাংলা নববর্ষ উৎসব উদ্যাপন করে। ভারতের আসামে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের উৎসব চলে ৮ দিন ধরে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী লোকজ ধারায় বাংলা বর্ষবরণের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক রুচিবোধ।
সরকারিভাবে আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা পঞ্চাশ। তবে সিলেট অঞ্চলে এর অর্ধেক সংখ্যক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ত্রিপুরা (টিপরা), মণিপুরি ও খাসিয়া সম্প্রদায়। এ তিনটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে প্রতি বছর উদযাপন করেন বাংলা নববর্ষ উৎসব। সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ি ও সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষরা প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিগত বছরের শেষ দিন অর্থাৎ ত্রিশ চৈত্র সন্ধ্যায় ও বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভোরবেলায় নানা ধরনের উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন। এ সময় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাসের স্থানগুলো পরিণত হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী-বাঙালিদের মিলনমেলায়। দুয়ের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য জোরদারের জন্য এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও সমতলের সর্বত্রই চলে উৎসবের আয়োজন।
ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ : বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ এবং হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট ও বাহুবল উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় পাড়াবদ্ধ হয়ে ৮ হাজারের বেশি ত্রিপুরা আদিবাসী বসবাস করছেন। তারা প্রতি বছর বাংলা বছরের শেষ দিন উদযাপন করেন ‘বৈসু’ উৎসব বা ‘হারি বৈসু’ নামের এক বিশেষ উৎসব। ‘বৈসু’ উৎসবই ত্রিপুরাদের একটি প্রধান উৎসব। ওইদিন ত্রিপুরা নারীরা নিজেদের পাড়া বা পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে ‘লাংগা’ (ঝুড়ি) নিয়ে হাসিখুশিতে নেমে পড়েন ‘দালক’ (শাকসবজি) সংগ্রহ করতে। ‘দালক’ (শাকসবজি) সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরা যুবতীরা গভীর পাহাড় থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও ফলমূল। ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে সর্বমোট ১০৮ জাতের লতাপাতা ও ফলমূল সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে সবগুলো একসাথে রান্না করে নিজেরা খাওয়ার সাথে সাথে অতিথি আপ্যায়ন করেন। যে ১০৮ জাতের ‘দালক’ এ বছর সংগ্রহ করেন তারা, তার মধ্যে থাকে ‘মুইচিং’ (বাজরাং পাতা), ‘ওরাই’, ‘সামছাতা’ (থানকুনি পাতা), ‘কেংকু’ (ঢেঁকিশাক), ‘থাবুচুক বিলাই’ (শিমুল আলু পাতা), ‘গানডুরই’ (বন ডুগি) ইত্যাদি। ওইদিন ত্রিপুরা পাড়ায় প্রতিটি ঘরে ওই ১০৮ জাতের দালক নিয়ে সবজি রান্না করে একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে অতিথিদের সাথে নিয়ে সবাই একসাথে তা আহার করেন। শুধু ‘হারি বৈসু’র দিনেই অর্থাৎ ৩১ চৈত্র তারা এসব রান্নার আয়োজন করেন। এটি তাদের শত শত বছরের ঐতিহ্য। ত্রিপুরাদের মনে বিশ্বাস হচ্ছে যে, ‘হারি বৈসু’র দিনে অর্থাৎ ৩১ চৈত্র বনৌষধি হিসেবে ‘দালক’ খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এ বিশ্বাসকে ভিত্তি করেই তারা শত শত বছর ধরে এ রান্না করে থাকেন।
বৈশাখের আগমনে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে বাংলা সালের প্রথম দিনে ত্রিপুরারা পালন করেন ‘কতর বৈসু’ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ। এ দিনে ত্রিপুরা আদিবাসীরা পুরনো বছরের সব গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুনের আহ্বানে মেতে ওঠে। ত্রিপুরা আদিবাসীর নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী ও শিশুরা সবাই এই দিন নানা রঙ-বেরঙের পোশাক পরিধান করে থাকে। এছাড়া প্রতি বছর ‘হারি বৈসু’র দিনে অর্থাৎ ৩১ চৈত্র পুরো বছরে ত্রিপুরা আদিবাসীদের যাদের আত্মীয়-স্বজন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, সেই মৃত ব্যক্তিদের শেষ বিদায়ী অনুষ্ঠান হয়। তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং ত্রিপুরা সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিরা ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এ অনুষ্ঠানও তাদের শত শত বছরের একটি ঐতিহ্যের অংশ। ‘কতর বৈসু’ দিনে অর্থাৎ ১ বৈশাখ নিয়মানুযায়ী ত্রিপুরা নারী-পুরুষরা খুব সকালেই স্নান (গোসল) করে পবিত্র হয়ে কানে ফুল পরে আর হাতে ফুল নিয়ে ছোট-বড় সবাই নিজেদের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। ওইদিন ত্রিপুরা সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সিলেট অঞ্চলের ত্রিপুরা পাড়াগুলোতে তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘গরাইয়া নৃত্য’ পরিবেশিত হয়। ত্রিপুরা আদিবাসীরা এ নৃত্যে অংশ নেন। এভাবেই তারা পালন করেছেন এবারের নববর্ষ উৎসব।
মণিপুরি সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ : সিলেট অঞ্চলের সিলেট সদর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার মণিপুরি পাড়াগুলোতে বাংলা বছরের শেষ দিন থেকে মোট সাত দিনব্যাপী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উদ্যাপন হয়। মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়ারা বছরের শেষ দিনটিতে ‘বিষু’ বা ‘চেরৌ’ আর মণিপুরি মৈতৈরা ‘শাজিবু চৈরৌবা’ উদ্যাপন করে। বছরের শেষ দিনটিতে মণিপুরিরা সূর্যোদয়ের আগেই নিজেদের ঘর, ঘরের চারপাশ, ঘরের যাবতীয় ব্যবহার্য বস্ত্র, আসবাবপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তুলসীপাতা ভেজানো পানি ছিটিয়ে ঘর এবং বসতভিটা ‘পবিত্র’ করার পর রান্নাবান্না শুরু করেন। তারা এদিন অসংখ্য পদের সবজি দিয়ে নিরামিষ রান্না করে তাদের লৌকিক দেবতা ‘আপোকপা’ এবং কুলদেবতা ‘লামরদৌ’-এর উদ্দেশে ভোগ নিবেদন করেন। এরপর চলে সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে ঘর থেকে ঘরে রান্না করা খাবার পরস্পরের মধ্যে বিনিময়। এক ঘরের খাবার অন্য ঘরকে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়। সন্ধ্যায় মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রতিটি ঘরে তৈরি হয় নানা জাতের পিঠা। এ সময় মণিপুরি লেইসাঙ বা মন্দিরগুলো আরতি, পালা, কীর্তন ও মৃদঙ্গের শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। কোনো কোনো পাড়ায় বসে ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি নৃত্য ও গানের আসর। রাতভর চলে ঐতিহ্যবাহী নিকন, লাকাটিসহ নানান খেলা।
পহেলা বৈশাখে মৌলভীবাজার জেলার মণিপুরি সম্প্রদায় উদ্যাপন করে ঐতিহ্যবাহী ‘বিষু’ উৎসব। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানায় আদিবাসী মণিপুরি সম্প্রদায়। একসময় মণিপুরিদের ১০৮টি রান্না ভোগ দেয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু বর্তমানে সমতলে বসবাসরত মণিপুরি সম্প্রদায়ের পক্ষে এত শাকসবজি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। বাংলা বছরের প্রথম দিনেও মণিপুরি তরুণ-তরুণীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘নিকন’ (পাশা খেলা), গিল্লা, লাকাটি ইত্যাদি খেলায় অংশ নেন।
খাসিয়াদের বর্ষবরণ : সিলেট অঞ্চলের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা, সিলেটের জয়ন্তিয়ায় পাহাড়ি জনপদে খাসি বা খাসিয়াদের বাস। তাদের বর্ষবরণের উৎসব হলো ‘সেংকুটসনেম’। ৩০-৩৫টি খাসিয়াপুঞ্জির বাসিন্দারা একত্র হয়ে একটি পুঞ্জির মাঠে পালন করে থাকেন তাদের শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘সেংকুটসনেম’ উৎসব। পুরনো বছরের পর্যালোচনা ও নতুন বছরকে সুন্দরভাবে সাজানো এই ব্রতকে সামনে রেখে প্রতি বছর দুদিনব্যাপী উৎস চলে খাসিয়াপুঞ্জিতে। প্রথম দিনে খাসিয়া গণনা অনুযায়ী তাদের বষের্র সমাপ্ত লগ্নে আয়োজন হয় আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও তাদের ঐতিহ্যবাহী সিয়াট খ্নাম (তীর নিক্ষেপ), সিয়াট বাতুল (ঘোলেল মারা) এবং কিউট থেনন (তেলমাখা বাঁশে ওঠা) প্রতিযোগিতা। এদিন যে পুঞ্জিতে উৎসবের আয়োজন করা হয়, সে পুঞ্জিতে বসে ঐতিহ্যগত খাবার ও ঐতিহ্যবাহী খাসিয়া পোশাক নিয়ে বিরাট মেলা। উৎসবের প্রথম দিনে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী তাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা দা, ঝুড়ি, কাপড়, প্রসাধনী, শাকসবজিসহ নানা সামগ্রী ও পণ্য নিয়ে উৎসব উদ্যাপনস্থলে বসে মেলা। আর দ্বিতীয় দিন মেলা থেকে ক্রয় করে আনা নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী দিয়ে খাওয়ার আয়োজন করে থাকেন সিলেট অঞ্চলের খাসিয়া সম্প্রদায়।
চলতি বছরে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে বৃহত্তর সিলেটের ত্রিপুরা, মণিপুরি, খাসিয়া সম্প্রদায়ের বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনেকটা সংকুচিত এবং ঘরোয়া পরিবেশে পালিত হবে।
লেখক :ইসমাইল মাহমুদ
লেখক ও কলামিস্ট