ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে তিন দিনের টানা বৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে ৩২ জেলায় তিন লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আবাদ করা ২২ ধরনের ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমন ধান, বোরো বীজতলা ও শীতকালীন সবজির। কৃষকরা বলছেন, মাঠে কেটে রাখা ধান বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। মাড়াইয়ের অপেক্ষায় থাকা ফসলও নষ্ট হচ্ছে উঠানে। আমন ধানের এক-তৃতীয়াংশই ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠী, পটুয়াখালী, ভোলা, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাও ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
জাওয়াদের প্রভাবে ফসলি জমির ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক এ কে এম মনিরুল আলম বলেন, বৃষ্টিতে ৩ লাখ হেক্টরের বেশি ফসলের জমি আক্রান্ত হয়েছে। এখনো পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। দেশের কোথাও কোথাও এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোথাও বৃষ্টি থেমে গেছে। পানি নেমে গেলে ফসলের তেমন ক্ষতি হবে না। আমরা ক্ষতি নিরূপণে কাজ করছি। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আমন মৌসুমে ৫৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ৪৬ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। এরই মধ্যে দেশের প্রায় ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়। খুলনার বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলার ৩ হাজার ২০২ হেক্টর জমির পাকা ও আধাপাকা রোপা আমন ধানের খেত পানিতে তলিয়ে গেছে। বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’-এর প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে পাকা ধান, ধান-গমের বীজতলা, রবিশস্য ও শীতকালীন সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সদর উপজেলায় ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষক ও কৃষি বিভাগ।
পটুয়াখালীতে টানা বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে আমন, তরমুজ ও খেসারি ডালসহ ২ হাজার ৮৮৫ হেক্টর জমির ফসল। মানিকগঞ্জে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। নড়াইলে ১৮ হাজার ৬৩২ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝিনাইদহে হাজার হাজার একর পাকা ধানসহ শীতকালীন ফসলের খেত তলিয়ে গেছে। টাঙ্গাইলের ১২ উপজেলায় আবাদ করা সরিষা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষক। ফেনীতে এক হাজারের অধিক কৃষকের আমন ধানসহ বিভিন্ন শীতকালীন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ময়মনসিংহের এক-তৃতীয়াংশ ধান ক্ষেতে রয়ে গেছে। এসব ধান কেটে ক্ষেতেই রাখা হয়েছিল। প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল ধানের ন্যাড়াগুলো। টানা বৃষ্টিতে সব এখন নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও ফসলের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
খুলনা : বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলার ৩ হাজার ২০২ হেক্টর জমির পাকা ও আধাপাকা রোপা আমন ধানের খেত পানিতে তলিয়ে গেছে। বোরো বীজতলা ও ২০ হেক্টর জমির শীতকালীন সবজি খেত নষ্ট হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খুলনা অঞ্চলের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন। খুলনা জেলায় এ বছর ৯৩ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে আমন ধান রোপণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ ধান হয়েছে। বর্তমানে জমিতে থাকা ৩০ ভাগ পাকা ধান বৃষ্টিতে আক্রান্ত। এ ছাড়া কয়রা ও পাইকগাছার বেশির ভাগ মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. আকতারুজ্জামান দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন।
বাগেরহাট : বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’-এর প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে পাকা ধান, ধান-গমের বীজতলা, রবি শস্য ও শীতকালীন সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মাঠে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ধান ঝড়ে পড়েছে। বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য
অনুযায়ী, টানা দুইদিনের বৃষ্টিতে বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ১৫০ হেক্টর পাকা আমন ধান আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া ২০৭ হেক্টর বোরোর বীজতলা, গমের বীজতলা ১৭ হেক্টর, ১৩৭ হেক্টর সরিষা ক্ষেত, ১৬১ হেক্টর খেসারি, ৩০ হেক্টর মসুর ডাল, ৩৫ হেক্টর শীতকালীন সবজি ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভোলা : ভোলা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন জানান, এ উপজেলায় প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল এখন পানির নিচে তলিয়ে আছে। কৃষি অফিসের তথ্যমতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন সদর উপজেলার প্রায় ২৭ হাজার কৃষক। সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মঞ্জুর আলম জানান, তারা মাঠে গিয়ে কৃষক ও ফসলের খোঁজখবর নিচ্ছেন। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও ফসলের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
পটুয়াখালী : ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে তিন দিনের টানা বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে আমন, তরমুজ ও খেসারি ডালের বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, আমন ধানের তেমন ক্ষতি হবে না। কিন্তু নিচু এলাকায় আমন, খেসারি, তরমুজ ও শাকসবজির কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করা হচ্ছে। পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম মহিউদ্দিন জানান, জেলায় এ বছর ১ লাখ ৯৯ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদ করা হয়। এর মধ্যে ৫০০ হেক্টর জমির আমন ফসলের কিছুটা ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। খেসারি ডাল ২ হাজার হেক্টর, তরমুজ ২৫ হেক্টর, শাকসবজি ৩০০ হেক্টর, সরিষা ১০ ও ধনের ২০ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। মোট ২ হাজার ৮৮৫ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে।
মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জে এবার ৩৭ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ২ হাজার ৭০৬ হেক্টর জমিতে খেসারির আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে ৩০ হেক্টর জমিতে। ২৬ হেক্টর জমির আলু, ৩০ হেক্টর পিঁয়াজ ও ৫৬৮ হেক্টর জমির গাজর খেত প্লাবিত হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে বীজতলার সব বীজ পচে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। জেলা খামারবাড়ির উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আরও দু-তিন দিন লাগবে।
নড়াইল : কৃষি সম্প্রসরণ অধিদপ্তরসূত্রে জানা গেছে, গত তিন দিনের টানা বৃষ্টিতে ১ হাজার ৪৫ হেক্টর জমির শীতকালীন ফসল, ১৬২ হেক্টর জমির বোরো বীজতলা, ৫০ হেক্টর জমির মরিচ, ৭ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমির সরিষা, ৭ হাজার ৫৪৫ হেক্টর জমির মসুর ও ২ হাজার ১০০ হেক্টর জমির গম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহে জাওয়াদের প্রভাবে পানিতে ভাসছে কৃষকের স্বপ্ন। টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে হাজার হাজার একর পাকা ধানসহ শীতকালীন ফসলের খেত তলিয়ে গেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে আমন ধান, পিঁয়াজ, রসুন, মসুর, গম, আলু, ভুট্টা, মরিচসহ নানা শাকসবজি। মাঠে মাঠে কেটে রাখা ধান পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে বৃষ্টির ফলে অনেক জমির সরিষা চারা গাছ নুয়ে পড়েছে। নিচু জমিতে পানি জমেছে। বাসাইল কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের জিকাতলী পাড়া গ্রামের চাষি ফণীন্দ্র ম্লল বলেন, ‘আমি এ বছর ৪০০ শতাংশ জমিতে সরিষা আবাদ করেছি। অসময়ে বৃষ্টির ফলে অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।’
ফেনী : ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে গত ৩ দিনের ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে ফেনীতে এক হাজারের অধিক কৃষকের আমন ধানসহ বিভিন্ন শীতকালীন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া ভারি বর্ষণের ফলে জেলার ৩০৫ হেক্টর আমন ধান দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে। এমন তথ্য জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফেনীর উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কান্তি সেন।
ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কৃষক মোস্তফা বলেন, কৃষকের এক-তৃতীয়াংশ ধান ক্ষেতে রয়ে গেছে। এসব ধান কেটে ক্ষেতেই রাখা হয়েছিল। প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল ধানের ন্যাড়াগুলো। এখন এসব ধান মাড়াই করতে খুবই কষ্ট হবে। ক্ষেতে থাকা এসব ধান অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া বাড়িতেও নষ্ট হয়েছে মাড়াইয়ের অপেক্ষায় থাকা কিছু ধান। নষ্ট হয়েছে সিদ্ধ করা ধানও। সব মিলিয়ে অসময়ের এই বৃষ্টিতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার হরশী গ্রামের হিমেল সারাবাংলাকে বলেন, অধের্কেরও কম ধান বাড়িতে তুলতে পেরেছি। ধান কেটে মাঠেই রাখা হয়েছিল, সেগুলো দুয়েকদিনের মধ্যে মাড়াই করা হতো। কিন্তু বৃষ্টিতে এখন সেসব ধান পানির নিচে। আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছি। নষ্ট হয়েছে আলু ক্ষেত। কয়েকদিন আগেই আলু রোপণ করা হয়েছিল। এসব আলু নষ্ট হয়ে গেছে।
নরসিংদী : নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার চন্দনপুর গ্রামের কৃষক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, এক-তৃতীয়াংশ ধান ক্ষেতে রয়ে গেছে। কিছু ধান কাটা ছিল। আর কিছু ধান কাটা হয়নি। ক্ষেতে থাকা সব ধানেরই ক্ষতি হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ : মুন্সীগঞ্জ থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আলু উৎপাদনের শীর্ষে থাকা জেলাটিতে বৃষ্টির প্রভাবে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর জেলার ৬ উপজেলার ৩৭ হাজার ৯শ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে ১৭ হাজারের বেশি হেক্টর জমিতে আলু বীজ রোপণ করেছিলেন কৃষকরা। এসব জমির প্রায় ৮০ শতাংশ বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। টানা বৃষ্টিতে সব জমিতেই জমেছে পানি। নিচু এলাকার জমিগুলো আবার একবারেই পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েকটি স্থানে সেচ দিয়ে পানি নিরসনের চেষ্টা চালাচ্ছেন কৃষকরা।