সারা দেশে বন্যায় প্রায় অর্ধকোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট ও ময়মনসিংয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। একদিকে ত্রাণের অপ্রতুলতা অন্যদিকে ভেঙে পড়েছে সড়ক-মহাসড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থা। শত শত স্কুল বন্ধ। লাখো শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল সোমবার বাংলাদেশের খবরের প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে কোরবানির ঈদের আগেই এসব সড়ক-মহাসড়ক মেরামত করার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান মন্ত্রী।
জামালপুর প্রতিনিধি জানান, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি কমতে থাকলেও জামালপুরে বন্যার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলার সাত উপজেলায় ৬২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক ও রেলপথ, তলিয়ে গেছে ২৫ হাজার ৯০০ হেক্টর ফসলি জমি। বন্যাকবলিত এলাকায় এক হাজার ১২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২ লাখ ৫৬ হাজার পরিবারের ১৩ লাখ মানুষ এবং ৪ লাখ ৫০ হাজার গবাদিপশু।
গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ৩৯ সেন্টিমিটার কমেছে। গতকাল সকালে যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৭১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে পানি কমলেও শুকনো খাবারের তীব্র অভাবের পাশাপাশি শিশু খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি এবং গো খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দুর্ভোগ। এখনো ঘরে ফিরতে পারছে না বন্যাদুর্গতরা। গত ১০ দিনে ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।
বানভাসিদের জন্য অপ্রতুল ত্রাণের কারণে হাহাকার দেখা দিয়েছে। বিশাল এলাকাজুড়ে বন্যা হওয়ায় জনপ্রতিনিধিরা পড়েছেন চরম বিপাকে। তারা বন্যাকবলিত সবার কাছে পৌঁছাতে পারেননি।
জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, বন্যার ফলে ৫৭টি ইউনিয়নের ৮৯৪টি গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে প্রায় দুই লাখ পরিবারের ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। পানি উঠেছে প্রায় দুই লাখ ঘরবাড়িতে।
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি কমা অব্যাহত থাকলেও এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বাঁধভাঙা পানি এখনো নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধা ও গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা এবং ৪৯টি ইউনিয়নের ৩৮৩টি গ্রামে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৩২৮ জন।
বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিবন্দি পরিবারগুলোর মধ্যে বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন এবং জ্বালানি সংকট বিরাজ করছে। এদিকে পানিবন্দি মানুষদের বন্যার পানিতে দেখা দিয়েছে, নানাবিধ রোগ-জীবাণুর ভাইরাস। ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়া পরিবারগুলো নৌ-ডাকাতির শঙ্কায় রয়েছে। অনেক চরবাসী রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, গতকাল সকালে গাইবান্ধার ফুলছড়ি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ২১ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার, শহরের ব্রিজরোড় পয়েন্টে ঘাঘট নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপরে বইছে। এ ছাড়া করতোয়া নদীর পানি নতুন করে বৃদ্ধি না পেলেও এখনো বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নিতাই তীর ভেঙে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে হালুয়াঘাট উপজেলার নড়াইল, বিলডোরা, শাকুয়াই ইউনিয়নসহ ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে উপজেলার প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ।
সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হালুয়াঘাট উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে উপজেলার প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ।
বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি দ্রুত কমতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে ফসলি জমির ক্ষয়ক্ষতির চিত্রও ফুটে উঠছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যায় যমুনা তীরবর্তী সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার মোট ৬৬ হাজার ৬৩৫টি কৃষি পরিবারের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষকরা জমির ফসল হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, যমুনার পানি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বিপদসীমার নিচে নেমে যাবে। সারিয়াকান্দিতে গতকাল বাঙ্গালী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
জামালপুর প্রতিনিধি জানান, জামালপুরের ইসলামপুরে সব রেকর্ড ভেঙে বিপদসীমার ১৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনার পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার আবদুল মান্নান বলেন, জামালপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ।
সাঘাটা (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর পানি কমলেও চরম দুর্ভোগে পড়ছে বন্যাদুর্গত এলাকার বানভাসি মানুষ। চারপাশে পানি থাকায় ঘর থেকে বের হতে পারছে না দুর্গত এলাকার মানুষ। পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে এসব লোকজন। কিছু শুকনো খাবার ও কিছু চালে সীমাবদ্ধ রয়েছে ত্রাণ বিতরণ। সরেজমিন দেখা গেছে, গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিতদের তেমন খাবার নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে।
শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও গবাদিপশু নিয়ে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ কমেনি। বাঁধে আশ্রিত শত শত গরু আর মানুষ একসঙ্গে খোলা আকাশের নিচে অথবা পলিথিন টানিয়ে বাস করছে। এতে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। ১ সপ্তাহ ধরে কৈজুরি ইউনিয়নের জয়পুরা থেকে জগতলা পর্যন্ত প্রায় ৪ কিলোমিটার নতুন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে গবাদিপশু নিয়ে আশ্রিত মানুষ এমন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের ভাগ্যে এখনো পর্যন্ত জোটেনি কোনো ত্রাণ সহায়তা।
সিলেট ব্যুরো জানায়, গত দুদিনের বৃষ্টিতে আবারো বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি। সিলেট অঞ্চলের পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বেলা ১২টার প্রাপ্ত রিডিং অনুযায়ী কানাইঘাটে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর অমলশিদে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শেওলায় কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। তবে সিলেটে সুরমা নদী, লোভা ও সারি নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও এখনো বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।