বিশ্বজিত রায়
বিশ্ব ক্রিকেটে ইতিহাস সৃষ্টিকারী রথী-মহারথীদের পেছনে ফেলে সম্মুখ কাতারে চলে আসছেন আমাদের টাইগাররা। সম্প্রতি শেষ হওয়া জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে চলমান সিরিজে রেকর্ডসম মাইলফলকে যুক্ত হতে পেরেছে দেশের ক্রিকেট। ক্রিকেটবিশ্বের রেকর্ডীয় জায়ান্ট স্ক্রিনে ঝলমল করছে মুশফিক, মমিনুল, মিরাজ, সাকিব, তাইজুল, নাঈমদের নাম। অবিশ্বাস্য কৃতিমাল্যে টাইগাররা এখন একেকটি বিজয় ফুল।
১৯৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রপি জিতে ক্রিকেটাররা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করলে ক্রিকেটবৈরী বাংলাদেশে কিছুটা পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সেই পরিবর্তনের হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ’৯৯-এর বিশ্বকাপে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম শক্তিধর পাকিস্তানকে হারিয়ে বাঙালিকে আনন্দরঙে ভেসে যাওয়ার সুযোগ এনে দেয় টাইগাররা।
রেকর্ডের অন্যতম দূত সাকিবকে দিয়েই শুরু করা যাক টাইগার ক্রিকেটের কীর্তিখাতা। সিরিজের প্রথম টেস্টেই দেশে প্রথমবারের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পথে দুইশ উইকেট আর তিন হাজার রানের ‘জোড়া কীর্তি’ গড়ার অভিজাত ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন সাকিব আল হাসান। এতে পেছনে ফেলা হয়েছে বেশ কয়েকজন কিংবদন্তি ক্রিকেটারকে। তবে এ কীর্তি গড়তে সাকিব নিয়েছেন সবচেয়ে কম সময়, মাত্র ৫৪ টেস্ট। এর আগে সবচেয়ে কম অর্থাৎ ৫৫ টেস্টে ইয়ান বোথামের পূর্ণ হয়েছিল এই ‘ডাবল’। সদ্য ইনজুরি থেকে ফেরা সাকিবের রেকর্ড আসলে নতুন কিছু নয়। তার নামের পেছনে হরহামেশাই যুক্ত হচ্ছে ক্রিকেট কীর্তি, যেটা বাঙালির জন্য গৌরবের। বিশ্ব রেকর্ডধারী সাকিবের সঙ্গে জিম্বাবুয়ে-বাংলাদেশ সিরিজে সাদা পোশাকে ‘মিস্টার ডিপেনডেবল’ মুশফিক পান ডাবল সেঞ্চুরি। টেস্ট ইতিহাসে কোনো উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের ‘ডাবলের ডাবল’ এবং বাংলাদেশি কোনো ব্যাটসম্যানেরও দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি এটিই প্রথম।
তা ছাড়া ২০১৮ সালে ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণে একটি মাত্র ডবল সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছে ক্রিকেটবিশ্ব। আর সেটিরও মালিক মুশফিকুর রহিম। মুশফিকের পর তাইজুলের নামটি না বললেই নয়। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে টানা তিন ইনিংসে ৫ বা তার বেশি উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। এরপর দুই ইনিংস বিরতি দিয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে ৬ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ধস নামিয়েছিলেন। এই ম্যাচের ৭টিসহ ৪০ উইকেট নিয়ে ২০১৮ সালে টেস্ট উইকেট শিকারির তালিকায় চার নম্বরে উঠে এসেছেন তাইজুল। এরই মধ্যে দেশের হয়ে দারুণ এক রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন বাংলাদেশের এই বাঁ-হাতি স্পিনার। এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার মালিক এখন তাইজুল (৪০)। সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ-বাংলাদেশ টেস্ট সিরিজের সমাপ্তি হয়েছে রেকর্ড জয় দিয়ে, যা এর আগে করে দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ। এখন টাইগারভক্তদের মনে লেগেছে কীর্তি গড়া ক্রিকেটের উৎসব আবির। মুশফিক, মমিনুল, সাকিব, তামিম, তাইজুলদের ধারাবাহিক কীর্তি, অর্জন, সাফল্য এ দেশের ক্রিকেটকে বসিয়েছে সম্মানের আসনে। একসময় দর্শকখরায় ভুগতে থাকা ক্রিকেট আজ বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, আগ্রহ, আনন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। ম্যাশ-মুশি-সাকি এক্সপ্রেসের চোখধাঁধানো খেলা দেখতে মাঠ কিংবা পর্দা সবখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বাঙালি। তারা টাইগার দলের সফলতায় যেমন নেচে-গেয়ে আনন্দ উদযাপন করছেন, তেমনি হারের বেদনায় কাঁদছেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
যারা টাইগার ক্রিকেটকে সবসময় তুলোধুনা করত, তারাই আজ বাংলা ওয়াশের শিকার হচ্ছে। ক্রিকেট বাঙালির আধিপত্যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে গিয়ে তারা প্রশংসার সুরভিতে ভাসাচ্ছে বাংলাদেশ দলকে। বিশ্ব ক্রিকেটের ক্ষমতাধর দেশগুলো একে একে টাইগারদের কাব্যিক ক্রিকেটে ধরাশায়ী হলেও একমাত্র ভারত তার নিজস্ব স্বার্থ অর্থাৎ জয় ছিনিয়ে আনার অলীক ধান্দায় ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করছে। বাংলাদেশের মতো সদ্য শক্তিমত্তায় বিস্ফোরিত দলকে অযাচিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে বার বার হারিয়ে দিচ্ছে। এটা ক্রিকেটের জন্য বড় লজ্জা ও নিন্দার। কোনো বৈশ্বিক আসরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা অনুষ্ঠিত হলে বাঙালি ভাবতে থাকে প্রতিবেশী দেশটির আইসিসি নিয়ন্ত্রিত অযাচিত হস্তক্ষেপের কথা। বাংলাদেশের ক্রিকেট যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই এগিয়ে যাওয়ার গতি মাঝে মাঝে থেমে যায়। এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। খেলায় দেশটির অনৈতিক প্রভাব বিস্তার টাইগার ক্রিকেটকে প্রায়ই জয়বঞ্চিত করছে। বিশ্ব ক্রিকেটকে মুঠোবন্দি করে ভারত যে অনৈতিক মাতব্বরি দেখাচ্ছে, তাতে ক্রিকেটের শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বৈকি!
লেখক : কলামিস্ট
bishwa85@gmail.com