শেখ মুজিবুর রহমান এক মহানায়কের নাম। এদেশের বঞ্চিত মানুষকে ভালোবেসে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। নির্যাতিত ও নিপীড়িত জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা এবং বিশ্ববুকে তুলে ধরেছেন লাল-সবুজের একটি পতাকা। বঙ্গবন্ধু এ জাতির জন্য এমন একটি নাম, যিনি দেখিয়েছেন শান্তির পথ, শুনিয়েছেন আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি।
আজ থেকে আটচল্লিশ বছর আগে একাত্তরের ৭ মার্চে বিশ্ববাসী শুনেছিল বজ্রকণ্ঠের বজ্রধ্বনি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া অসাধারণ ভাষণটি শত্রুপক্ষের কপালে এঁকে দিয়েছিল চিন্তার ভাঁজ। গাঁয়ের মেঠোপথ থেকে শহরের রাজপথ হয়ে জনস্রোত গিয়ে মিশেছিল ঢাকার রেসকোর্সে। সব শ্রেণিপেশার মানুষে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল তখনকার রেসকোর্স ময়দান। প্রতিবাদী জাতির ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে রেসকোর্স ময়দানসহ সমগ্র পূর্ব বাংলা। কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার ভাষায় বলতে হয়— কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে/এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,/লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,/পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।/হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,/নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে/আর তোমাদের মতো শিশু পাতা- কুড়ানীরা দল বেঁধে।/একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল/প্রতীক্ষা মানুষের: ‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’/শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/হূদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতা খানি:/‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের পুরো ভাষণটিকে কবি তার মতন করে একত্রিত করে নিপুণ ভাষায় রচনা করেছিলেন উক্ত কবিতাটি।
শত্রুপক্ষের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে কবি শোনালেন তার মহাকাব্যিক রচনাটুকু। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শিরোনামের রচনায় উঠে আসে লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার প্রতিবাদমুখর একটি জাতির সমগ্র হিসাব-নিকাশ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ওই ভাষণটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি হিসেবে স্থান পায় ইতিহাসের পাতায়। ভাষণে ব্যবহূত প্রতিটি বাক্যের প্রতিটি শব্দ নিপুণভাবে সাজিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধুর মুখেই অনর্গল উচ্চারিত হয়ে আসছিল ৭ মার্চের অলিখিত বিখ্যাত ভাষণটি।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণটি শুরু করেছিলেন— ‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি’ বলে। গভীর চিন্তায় মগ্ন জাতির পিতা সেদিন সমগ্র বাঙালিকে ভাই বলে সম্বোধন করেন। বাংলা ও বাঙালিকে তিনি কতটুকু ভালোবাসতেন, তার বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ ও বাক্যেই তা প্রতীয়মান হয়। জুলুমবাজ পাকিস্তানের নিপীড়ন ও নির্যাতনের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তিসহ সার্বিক ক্ষেত্রে অধিকার আদায়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। তিনি আবারো উচ্চারণ করেন— ‘ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইড্রো করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না।’ তিনি পাকিস্তানি স্বৈরাচারদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে সাবধান করে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’ সমগ্র বাঙালিকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ বলে মহাকাব্যিক বক্তব্যের ইতি টানেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর থেকেই ৭ মার্চ ঐতিহাসিক দিন হিসেবে স্থান করে নেয় ইতিহাসের পাতায়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেদিন সাড়া দিয়ে পুরো বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে। এর পরের ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের।
লেখক : নিবন্ধকার