মো. আফসারুল আলম মামুন
একজন মানুষের জীবনে প্রকৃত বন্ধুর খুবই প্রয়োজন। জীবনের নানা ধাপের চরাই উতরাই পেরুতে এখন প্রকৃত বন্ধুর প্রভাব অনস্বীকার্য। বন্ধুত্ব এমন একটা জিনিস যার দ্বারা মানুষ হাজারো কঠিন কাজ কাজকে সহজেই সমাধান করতে পারে। বন্ধুর কথায় নিমিষেই মন পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এমনকি বন্ধুর বন্ধুও বন্ধু হয় শুধুমাত্র বন্ধুর প্রতি মহব্বতের কারণে। তাই প্রথমেই আমাকে বন্ধু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নানা বিষয় বিবেচনা করে নেওয়া উচিত। কারো প্রতি মন সামান্য আকৃষ্ট হলেই তার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে এমনটা ভাবা উচিত নয়। বরং প্রথমে পর্যালোচনা করে দেখত হবে ভালো লাগা বা তার প্রতি আকর্ষণের কারণ বা উৎসটা কী?
হজরত আলী (আ.) থেকে বর্ণিত-যে ব্যক্তি চিন্তাভাবনা করে যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ করে বন্ধু নির্বাচন করবে, তাদের বন্ধুত্ব বজায় থাকবে এবং তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হবে। অর্থাৎ আমাকে প্রথমে সৎ মানুষ চিনতে হবে এবং তারপর তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। যে ব্যক্তি আমাকে অবৈধ কাজে ডাকে, অবৈধ কাজ করতে উৎসাহ দেয় সে কখনো আমার বন্ধু হতে পারে না। আজ যে আমাকে তার নিজের টাকায় সিগারেটসহ যে-কোনো মাদক উপহার দেয়, সে আর যাই হোক আমার ভালো চায় না। সাময়িকভাবে তার উপহারকে খুবই আনন্দদায়ক মনে হলেও এর পেছনে তার বিরাট কূটকৌশল বিদ্যমান। তাই একজন মুসলমানদের উচিত বন্ধু নির্বাচনে সর্তক হওয়া। একজন বন্ধু যেমনিভাবে জান্নাতের দিকে নিতে পারে তেমনিভাবে একজন বন্ধু জাহান্নামের পথটাও ধরিয়ে দিতে পারে। ঐতিহাসিক একটা ঘটনা থেকে এই বিষয়ে আমরা আরো অনেক কিছু জানতে পারি।
হজরত মুসা (আ.) একদিন ফেরাউনকে দাওয়াত দিতে যেয়ে ফেরাউনকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘তুমি শুধু আমার এক আল্লাহকে মেনে নেও এবং বল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুসা কালিমুল্লাহ।’ তুমি দুনিয়াতেও যেমন বাদশাহ আছো আখিরাতেও তেমনি মর্যাদা পাবে। দুনিয়ার বাদশাহি তোমার চলে যাবে না। আমি তোমার বাদশাহিকে ধ্বংস হতে দেব না। কালেমা কবুল করার মাধ্যমে দুনিয়ার সাথে আখিরাতও পেয়ে যাবে। ফেরাউন মনে মনে ভাবল যদি দুনিয়ার বাদশাহি টিকে থাকে আর তার সাথে আখিরাতও পাই তাহলে ইসলাম কবুল করতে সমস্যা কি? তো সে মুসা (আ.)-এর কাছ থেকে সময় নিয়ে তার স্ত্রী আছিয়ার কাছে পরামর্শ নিতে গেল। আছিয়া শুনে বলল আপনি তাড়াতাড়ি দিন কবুল করে ফেলুন। এরপর ফেরাউন মুসা (আ.) কাছে আসতে লাগল। পথিমধ্যে তার সাথে দেখা হয় গেল তার অন্যতম সহচর হামানের। হামান তাকে বলল আমরাইতো আপনাকে প্রভু বলে জানি তাহলে আপনি কেন মুসার প্রভুর নিকট নত স্বীকার করবেন আপনিই তো সবচেয়ে বড়। এমন নানা ধরনের কথা বলে ফেরাউনকে মুসা (আ.)-এর দরবারে যেতে বাঁধা প্রদান করল এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামের পথ ধরিয়ে দিল। এই ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, একজন মানুষ কীভাবে বন্ধুত্বের প্ররোচনায় জাহান্নামের দিকে অগ্রসর হয়।
রাসুলের যুগের একটি ঘটনার দিকে যদি দৃষ্টি দেই তাহলে দেখি সেখানেও দেখা যায় বন্ধুত্বের মাধ্যমে কীভাবে একজন মানুষ ঈমানহারা হয়। ওক্ববা বিন আবু মু’আইত্ব ছিলেন সেই যুগের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। একদিন সে মক্কার বেশ কয়েকজন গুণী এবং বিশিষ্ট লোকদের দাওয়াত করল। কুরাইশ বংশের সদস্য হিসাবে আমাদের নবীও সেখানে দাওয়াত পেল। খাবার শুরুর আগে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওক্ববা বিন আবু মু’আইত্বকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি যদি মুসলমান না হও তাহলে তোমার খাবার আমি স্পর্শ করব না। এই কথা শুনে ওক্ববা কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল। ওক্ববার একজন বন্ধু ছিল যার নাম উবাই বিন খালাফ। উবাই বিন খালাফ যখন শুনতে পারল ওক্ববা মুসলমান হয়ে গেছে তখন ওক্ববা ডেকে কটু কথা বলতে লাগল এবং বলল তুমি এখনই যাও এবং মোহাম্মদের সম্মুখে যেয়ে তার মুখে থুথু দিয়ে তার কালেমা অস্বীকার করবে। বন্ধুর এই কথা শুনে ওক্ববা গিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র মুখে থুথু নিক্ষেপ করল এবং বলল তোমার কালেমাকে আমি অস্বীকার করলাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা সুরা ফুরকানে ঘোষণা করেন, সে জাহান্নামে এই কথা বলে চিল্লাতে থাকবে"হায় আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার কাছে কোরআন আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল।
এমন হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত চারদিকে প্রবহমান। খারাপ বন্ধুদের প্রভাবে যখন পরিবারের কোনো সদস্য বিপথে চলে যায় তখন শুধু সেই পরিবার নয়, ধ্বংস হয় সমাজ, ধ্বংস হয় দেশ তথা বিশ্ব। দুনিয়া যেমনিভাবে নষ্ট হয় তেমনিভাবে আখিরাতও শেষ হয়ে যায়। তাই আমাদের উচিত ভালো বন্ধু খুঁজে তার সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করা। যে আমাকে জান্নাতের দিকে ডাকবে, ভালো কাজে উৎসাহ প্রদান করবে, সঠিক সময়ে নামাজের কথা বলবে, হারাম থেকে দূরে থাকার জন্য নসিহত করবে; আমরা এমন কাউকেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করব যে সৎ, চরিত্রবান, নিষ্ঠাবান, দিনি বুঝসম্পন্ন, আল্লাহকে ভালোবাসে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে ভালো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়