জি. এম. আরিফ
প্রতি বছরের মতো এ বছরও আমন মৌসুম শেষ হওয়ার পরপরই আশঙ্কাজনক হারে কেটে নেওয়া হচ্ছে কৃষিজমির টপ সয়েল (জমির উপরিভাগের মাটি)। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করার প্রবণতা ভয়ঙ্কর। তা হতে পারে কৃষির জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ। ফসলের উৎপাদনে আসতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। ক্রমাগত কমতে থাকবে ফসল উৎপাদন। যার ফলে অধিক চাষাবাদেও ফলন হবে কম। দেখা দেবে খাদ্য ঘাটতি। বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছর শীত মৌসুমে মাটি কাটার এই মহোৎসব অবাদে চলতে থাকে। শীত মৌসুমে মাঠ থেকে ফসল উঠে যাওয়ার পর পরই এ সময় মাটি কাটার জন্য এক্সকাভেটর, ট্রাক ও শ্রমিক সরবরাহ করতে থাকে একশ্রেণির মাটিখেকো সিন্ডিকেট।
দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা বৈধ-অবৈধ ইটভাটার মালিকদের প্রলোভনে পড়ে কিছু জমির মালিক না বুঝে অল্প টাকার লোভে নিজেদের জমির মাটি বিক্রি করে দেয়। অনেক সময় জমির মালিককে না জানিয়ে রাতের আঁধারেই কেটে নেওয়া হয় ফসলি জমির (টপ সয়েল) উপরিভাগের মাটি। এই চক্রের সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবাদ করার সাহসও পায় না জমির মালিকরা। দফায় দফায় প্রতি বছর প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করলেও কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে শীত মৌসুম শুরু হওয়ার পরপরই আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মাটিখেকো চক্রটি।
আবাদি জমির উপরিভাগ কেটে ফেলার ক্ষতি প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার মতে, প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মাটি সবচেয়ে মূল্যবান। জমির উপরিভাগের ছয় থেকে সাত ইঞ্চির মধ্যেই থাকে সব ধরনের জৈব গুণাগুণ। অথচ এটাই কেটে নেওয়া হচ্ছে। ফলে এসব জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশে কয়েক হাজার ইটভাটা রয়েছে। মূলত এসব ইটভাটার জন্য প্রয়োজন হয় মাটি। প্রশাসন কর্তৃক ইটভাটার জন্য পুকুর ও অনাবাদি জমির মাটি কাটার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু তারা তা না করে ফসলি জমির টপ সয়েল দেদার কাটছে। এতে একদিকে যেমন ধ্বংস হচ্ছে কৃষি জমি এবং জমির কমছে উর্বরতা। অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ চরম হুমকির মুখে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, কোনো ফসলি জমির টপ সয়েল কাটার অনুমতি কারোর নেই। এরই মধ্যে এ কাজ করার দায়ে অনেককে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করা হয়েছে এবং মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রতি বছর এ বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। চলতি বছরও অভিযান অব্যাহত রয়েছে কিন্তু তারপরও বন্ধ করা যাচ্ছে অবাদে মাটি কাটা। ফসলি জমির উপরিভাগ কাটা আমাদের পরিবেশের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। এটি দণ্ডনীয় অপরাধ, কিন্তু কে শোনে কার কথা। এই কাজে জড়িত প্রভাবশালী রাঘব-বোয়ালরা।
পরিবেশ সচেতনদের মতে, মাটির টপ সয়েল বিক্রি করতে জমির মালিকদের নানাভাবে প্ররোচিত করছে ইটভাটা মালিক ও ব্যবসায়ীরা। ইটভাটা মালিকরা জমির মালিককে টাকা লোভ দেখিয়ে বা জোর করে মাটি কেটে নিয়ে যায় বা তারা এটা বোঝায় যে, জমির উপরিভাগ কাটলে কোনো ধরনের ক্ষতি হয় না। শীত মৌসুমে মাটি কাটলে বর্ষা মৌসুমে সে মাটি ভরাট হয়ে যাবে। জমির জৈব গুণাগুণেরও কোনো ক্ষতি নেই। বিজ্ঞানের ভাষায় জমির টপ সয়েলে সবচেয়ে ঘনত্বের জৈবিক বস্তু থাকে বলে উদ্ভিদ পৃথিবীর প্রায় ৯৫ শতাংশ খাদ্য উৎপাদনে একে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করে।
এলাকার পরিবেশ সচেতন সাধারণ মানুষ মতে, এ চক্রের সঙ্গে অনেক প্রভাশালী মহল জড়িত। তাদের ছত্রছায়ায় এটি চলে আসছে বছরের পর বছর। যার কারণে মুখ খোলার সাহস পায় না এলাকার জনসাধারণ। আবার অনেকে সামান্য কিছু টাকার লোভে পড়ে বা পাশের জমির মাটি বিক্রি হওয়ায় জমি উঁচু হয়ে যায় ফলে সেচের পানি পায় না বাধ্য হয়ে নিজের অন্ন সংস্থানের একমাত্র অবলম্বন কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি কর দেয়।
আবার অনেক সময় নতুন নতুন ঘরবাড়ি তৈরি করার জন্য জমির মাটি কেটে ঘরভিটা উঁচু করে ফলে মানুষ নিজেরাও কৃষিজমির টপ সয়েল নষ্ট করে। অনেক সময় নতুন করে রাস্তা-ঘাট তৈরি করার জন্য জমির মাটি কেটে রাস্তা বানানো হয়, এতে জমির যেমন গুণাগুণ নষ্ট হয় তেমনি জমি তার নিজস্ব উর্বরতা হারায়। জমি দিন দিন তার উৎপাদন ক্ষমতা হারায় এবং একসময় অনুর্বর জমিতে পরিণত হয়। এ কারণে কৃষক কঠোর পরিশ্রম করেও তারা বেশি পরিমাণে ফসল উৎপাদন করতে পারেন না এবং ফলে বাড়তে থাকে কৃষকের উৎপাদন খরচ। এভাবে চলতে থাকলে কৃষক ফসল উৎপাদনে অনীহা প্রকাশ করবে এবং এতে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে।
পরিশেষে, কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে বন্ধ করতে হবে কৃষিজমির টপ সয়েল কাটার মহোৎসব। মাটি কাটার মৌসুমে গ্রামের জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য গণমাধ্যম বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে এবং মসজিদে মসজিদে খতিবের মাধ্যমে এ বিষয়ে মুসল্লিদের বলার অনুরোধ করতে হবে যাতে কৃষিজমির মালিকরা সচেতন হয়। খাদ্য ঘাটতি পূরণ করার জন্য কৃষিজমির গুরুত্ব অনুধাবন করে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, বাঁচাতে হবে কৃষক, কৃষি এবং দেশকে। পরিশেষে একটি স্লোগানের মাধ্যমে আজ আমার এই লেখার শেষ করব।
কৃষি বাঁচলে, বাঁচবে দেশ;
হাসবে কৃষক, দেখবে দেশ।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক