কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি শেষ

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি শেষ

  • কুষ্টিয়া সদর প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২০ নভেম্বর, ২০১৮

১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারত উপমহাদেশে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে পদ্মা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে। বিশেষ করে ভারতের দার্জিলিং ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে যাতায়াতের সুবিধার্থে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলার সীমারেখা পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করে। বিশেষজ্ঞদের মত ও নেমফলক অনুযায়ী (১৯১২ সালে স্থাপিত) ২০১২ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১০০ বছর পার করল।
ওই সময় পদ্মা নদীর পূর্বতীর বর্তমান কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা গোলাপনগর সাঁড়াঘাট আর পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়াঘাট ছিল দেশের অন্যতম বৃহৎ নদীবন্দর। যেখানে দেশি-বিদেশি বড় বড় স্টিমার, লঞ্চ, বার্জ, মহাজনী নৌকা ইত্যাদি ভিড়ত সাঁড়াবন্দরের ১৬টি ঘাটে। এমতাবস্থায় খরস্রোতা পদ্মা গর্ভে বহু লঞ্চ, স্টিমার ডুবে প্রাণহানি ও মালামালের ক্ষতিসাধিত হয়। বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দার্জিলিং ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে দেশি-বিদেশি পর্যটক যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে ভাতের কাঠিহার থেকে রেলপথ আমিন গাঁ আমনুরা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে অবিভক্ত ভারত সরকার তখন পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব পেশ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৯ সালের ব্রিজ তৈরির সেই প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে ১৯০২ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত চার বছর ধরে ব্যাপক স্টাডি করে ম্যাচ এফজে ইস্প্রিং একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে। দীর্ঘ জরিপের পর সাঁড়াঘাটের দক্ষিণে ব্রিজ নির্মাণের সম্ভাব্যতার তথ্য সরকারের কাছে সরবরাহ করা হয় এবং ১৯০৭ সালে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মধ্যবর্তী পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। ১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের মঞ্জুরি লাভের পর ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট উইলিয়াম গেইলসকে ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ হিসেবে, ব্রিজের মূল নকশা প্রণয়নের জন্য স্যার এসএম বেনডেলেগকে ও প্রকল্প প্রণয়নের জন্য স্যার ফ্রান্সিস স্প্রিং এবং ঠিকাদার হিসেবে ব্রেইথ ওয়াইট অ্যান্ড ক্লার্ককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এরপর শুরু হয় কূপ খনন, বসানো হয় ১৫টি স্প্যান যার প্রতিটি বিয়ারিং টু বিয়ারিংয়ের দৈর্ঘ্য ৩৪৫ ফুট দেড় ইঞ্চি এবং উচ্চতা ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১ হাজার ২৫০ টন। রেললাইনসহ ১ হাজার ৩শ টন। এছাড়াও দু’পাশে ল্যান্ড স্প্যান রয়েছে, যার দূরত্ব ৭৫ ফুট। ব্রিজটির মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৮৯৪ ফুট (১ মাইলের কিছু বেশি)। ব্রিজ নির্মাণে মোট ইটের গাঁথুনি ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, ইস্পাত ৩০ লাখ টন, সাধারণ সিমেন্ট ১ লাখ ৭০ হাজার ড্রাম এবং কিলডসিমেন্ট (বিশেষ আঠাযুক্ত) লাগানো হয় ১২ লাখ ড্রাম।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১ হাজার গজ ভাটি থেকে ৬ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত ১৬ কোটি ঘন ফুট মাটি ও ২ কোটি ৩৩ লাখ ৭০ হাজার ঘনফুট পাথর ব্যবহার করে গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রায় তিন কিলোমিটার প্রস্থ নদীর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-পাবনার পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণস্থলে দু’পাশে বাঁধ দিয়ে ১ দশমিক ৮১ কিলোমিটার নদী সঙ্কুচিত করা হয় এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের সময় ব্রিজটির অ্যালাইনমেন্টে নদীর পানির বহন ক্ষমতা দাঁড়ায় ২৫ লাখ ঘনফুট।

১৯১২ সালের আগে শ্রমিক সংখ্যা কম থাকলেও ১ ফেব্রুয়ারি ১৯১২ থেকে প্রকল্পটিতে কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। তখন থেকে ২৪ হাজার ৪ শত শ্রমিক যারা দীর্ঘ পাঁচ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৪ সালের শেষের দিকে ব্রিজটির কাজ শেষ করে। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম মালগাড়ি (ট্রেন) চালানো হয়। দুই মাস পর ৪ মার্চ ডবল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু করে। সে সময় ব্রিজটি ট্রেন চলাচলের জন্য উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। তার নামানুসার ব্রিজটির নামকরণ হয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।

তখনকার সময় ব্রিজটি তৈরিতে মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ টাকা। এর মধ্যে স্প্যানের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ৬ হাজার ৭৯৬, ল্যান্ড স্প্যানের জন্য ৫ লাখ ১৯ হাজার ৮৪৯, নদীর গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩৪৬ ও দুই পাশের রেললাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১৭৩ টাকা।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী ব্রিজটির ওপর একাধিক বোমা বর্ষণ করে। এর ফলে পিলারের ওপর থেকে ১২নং স্প্যানটির (গার্ডার) এক প্রান্ত নদীর মাঝে পড়ে যায়। ৯নং স্প্যানটির নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (যদিও পাকহানাদার বাহিনী না ভারতীয় বাহিনী ব্রিজটিতে বোমা বর্ষণ করেছে, তা নিয়ে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। পাকবাহিনীকে দক্ষিণ বঙ্গে প্রবেশ না করতে দেওয়ার কৌশলগত কারণে পিলারের ওপর এবং গার্ডারের নিচে ডিনামাইট বসিয়ে ওপর থেকে বোমা মেরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।) ফলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর যে বোমা দ্বারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ক্ষতিসাধন করা হয়, তা এখনো পাকশীস্থ বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজারের কার্যালয়ের সামনে সংরক্ষিত রয়েছে।

পরে ব্রিজটি মেরামত করে ভারতের পূর্ব রেলওয়ে শ্রী এইচকে ব্যানার্জী, চিফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী আরকে এসকে সিংহ রায়, ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার, শ্রী পিসিজি মাঝি, অ্যাসিসন্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়াও বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে ছিলেন রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ আলী, ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ ইমাম উদ্দিন আহমেদ, ডিভিশনাল সুপার এম রহমান প্রমুখ। মেরামতকৃত গার্ডারটি বর্তমানে কিছুটা দেবে গেছে, ফলে ট্রেন ইঞ্জিনের চালকরা গাড়ির গতি কমিয়ে ব্রিজ পারাপার হয়।

ব্রিজটি ১৯১২ সালে স্থাপন অনুযায়ী বর্তমান ২০১২ সালে ১০০ বছর পূর্ণ করল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তৎকালীক ব্রিটিশ সরকার ১০০ বছরের গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিল, এসময়ের মধ্যে ব্রিজটির কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটবে না। সত্যিই তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ১০০ বছর পার হয়েছে ব্রিজটির বয়স। এখন কী হবে? এখন কে দেবে এর ওয়ারেন্টি/গ্যারান্টি। সরকার বা সংশ্লিষ্ট মহলকে ভেবে দেখা দরকার। গাড়ি চলবে কিনা, চললেও কীভাবে চলবে, কতদিন চলবে এ চিন্তা আমাদের সবার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads