জি এম আরিফ
বর্তমান সময়ে দেশে শিক্ষিতের সংখ্যা যেমন বাড়ছে সে তুলনায় কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল চাকরির বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমান সময়ে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরাই খুব সহজে ভালো বেতনে চাকরি জুটিয়ে নিতে পারে। কিন্তু এর বাইরেও বিশাল জনগোষ্ঠী আছে যারা কোনো না কোনোভাবে মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়েছে। এই শিক্ষার্থীরাই আবার দারিদ্র্যের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অল্প বেতনে অল্প বয়সে কাজে যুক্ত হয়ে যায়, এই কাজ করতে করতে তারা আবার হাতেকলমে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ কাজ শিখে ভালো আয় করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রথম এবং প্রধান বাধা সার্টিফিকেট। তখন সে চিন্তা করে যদি একটি কারিগরি সার্টিফিকেট (ডিপ্লোমা) সনদ থাকত তাহলে সে নামকরা কোনো প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি করতে পারত। তখন ভর্তি হওয়ার মতো অর্থ থাকলেও যোগ্যতা বা বয়স থাকে না, ফলে তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে না।
আমার শিক্ষকতা জীবনে এমন বহু ছাত্র দেখেছি এসএসসির পরপরই কর্মে জড়িয়ে পড়তে। ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থী দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন কারিগরি কাজে অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, তারা পড়ালেখা ছেড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ শিখে পরিপূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেছে। তারা যেসব কাজের মধ্যে সম্পৃক্ত, যেমন কম্পিউটার, ইলেকট্রিক, ইলেকট্রনিকস, সার্ভে, মেকানিক্যাল, সিরামিক, পাইপ ফিটিং অ্যান্ড প্লাম্বার, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, হ্যান্ড মেইড আইটেম ইত্যাদি। এক সময় তারা পড়ালেখার মূল্য বুঝতে পারে এবং নিজের ভুল বুঝতে পারে, কিন্তু তখন আর কিছুই করার থাকে না।
বর্তমান সরকার এই ঝরে পড়া জনগোষ্ঠী এবং প্রবাসীদের জন্য কারিগরি (ডিপ্লোমা) শিক্ষায় নতুন করে পড়ালেখা করার সুযোগ দিতে পলিটেকনিক ভর্তিতে বয়স শিথিল করেছে এবং সেইসাথে ভর্তির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ফি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি যুগান্তকারী এই সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে বলেন, বর্তমান সরকার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবে কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। সে জন্য কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং বিদেশ ফেরত কর্মীদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ডিপ্লোমা কোর্স ভর্তিতে বয়স শিথিল করা হয়েছে।
এতদিন এসএসসি পাস করার পর দুবছর পর্যন্ত পলিটেকনিকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারত। শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হতো এসএসসিতে ছেলেরা ৩.৫০ এবং মেয়েরা ৩.০০। নতুন সিদ্ধান্তে পলিটেকনিকে ভর্তি হতে ছেলে ২.৫০ এবং মেয়ে ২.২৫, সেইসাথে বয়সের কোনো সীমাবদ্ধতা থাকছে না এবং ভর্তি ফি কমানো হয়েছে। এতে করে যেমন একদিকে অভিভাবকরাও খুশি তেমনি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীসহ প্রবাসীরাও খুশি, প্রত্যাশিত সনদ না থাকায় তারা দেশে এবং বিদেশে ভালো চাকরি পাচ্ছেন না। সরকারের নানাবিদ সমালোচনার মধ্যেও এই পদক্ষেপ দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলে সুধীজন মনে করেন। পেশাগত জীবনে কারিগরি শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে যদি সরকার বিভিন্নভাবে প্রবাসীদের আকৃষ্ট করে এই কোর্সে ভর্তি এবং কোর্স সমাপ্ত হলে দেশে-বিদেশে ভালো চাকরি পেতে সহযোগিতা করে।
পরিশেষে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সরকার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে কাজে সম্পৃক্ত করে আয় বা রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নাম লেখাতে পারবে। জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত এবং সহজেই বেকার সমস্যার সমাধান করতে পারবে, তখন সীমিত সম্পদ নিয়েও বাংলাদেশ হবে একটি ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত মডেল রাষ্ট্র। একটি স্লোগান দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। মনে করি, কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে স্লোগানটি যথার্থ— ‘কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষা নিলে/চাকরির সুযোগ সহজেই মিলে।’
লেখক : শিক্ষক