কারাগারের ভেতর অবাধ বিচরণ জঙ্গিদের

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

তালেবান ক্ষমতায় আসায় ভোজসভার আয়োজন

কারাগারের ভেতর অবাধ বিচরণ জঙ্গিদের

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ৩ নভেম্বর, ২০২১

কাশিমপুর কারাগার যেন জঙ্গিদের মিলনমেলা। অভিযোগ উঠেছে, কারাগারের ভেতরে তাদের নজরদারি করা হচ্ছে না। এমনকি বিভিন্ন উপলক্ষে তারা অন্য বন্দিদের জন্য ভোজের আয়োজনও করে। কিছুদিন আগে আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতায় আসার পর তারা ভোজসভা ও আনন্দ উল্লাস করেছে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্য কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক জামায়াত নেতা ও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি। সম্প্রতি কারাগারে জঙ্গিদের অবাধ বিচরণের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। প্রতিবেদনে কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও সুপারিশসহ নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কাশিমপুর কারাগার পার্ট-১ এ দুর্ধর্ষ জঙ্গি নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দণ্ডপ্রাপ্তসহ বেশ কয়েকজন হত্যার আসামি রয়েছেন। নব্য জেএমবির দুর্ধর্ষ বিল্লালও রয়েছে এ কারাগারে। বিল্লালই কারাবন্দি জঙ্গিদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মাঝে মধ্যেই তারা বিভিন্ন বৈঠকও করে। পাশাপাশি দর্শনার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করার সুযোগে বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন।

অভিযোগ রয়েছে, ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গিদের সক্রিয় করতে কারাগারে বসেই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করছে এসব জঙ্গি নেতা। বাইরে থাকা অনুসারীদের নানা নির্দেশনাও দিচ্ছেন। বিশেষ করে, মোবাইল ফোনে বিভিন্ন সিক্রেট অ্যাপসের মাধ্যমে এসব নির্দেশনা পাঠানো হয়। কিছু অসাধু কারারক্ষীর মাধ্যমে মোবাইল ফোন ম্যানেজ করে জঙ্গি নেতারা। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ নিয়ে সম্প্রতি কারাবন্দি জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) অন্যতম শীর্ষ নেতা নাহিদ তাসনিম ও আনসার আল ইসলামের অন্যতম শীর্ষ নেতা আল-আমিনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ও আনসার আল ইসলামের শীর্ষ চার নেতার মধ্যে কারাগারে যোগসাজশ হয়। তারা হলেন, জেএমবির নাহিদ তাসনিম ও আবু সাঈদ, আনসার আল ইসলামের আল আমিন ও হরকাতুল জিহাদের ফয়সল। তিন সংগঠনের আদর্শ প্রায় একই ধরনের হওয়ায় তারা কারাগারে বসেই মিশন বাস্তবায়নের অভিন্ন পরিকল্পনা করে। কারাগারের বাইরে থাকা অনুসারীদের মোবাইলে অর্থ সংগ্রহের নির্দেশনাও দেয়। নির্দেশনা অনুসারে তাদের সহযোগীরা পেশাদার ডাকাত দলের সঙ্গে মিশে শুরু করছে ডাকাতি। এই ডাকাতির অর্থের একটি অংশ চলে যায় কারাবন্দি শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের কাছে। কারাবন্দি নেতাদের নির্দেশনায় ডাকাতির টাকায় ‘হালাল ও ফ্রেশ’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলে জঙ্গিরা। আর বাকি অংশ ব্যয় করা হতো সংগঠনের কথিত দাওয়াতি কাজে।

গোয়েন্দারা জানান, কারাগার থেকে জঙ্গি নেতারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বাসায় ডাকাতির নির্দেশ দিয়েছিল। কারণ এসব ব্যক্তিকে তারা ‘তাগুত’ হিসাবে অভিহিত করে। তাই তাদের বাসায় ডাকাতি করা অন্যায় হবে না বলে মনে করে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর হাতিরঝিল ও তেজগাঁও এলাকায় ছয়টি ডাকাতির ঘটনায় পেশাদার ডাকাত দলের সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার আসিফের কাছ থেকে ২০ হাজার ও ১৫ হাজার করে দুই ভাগে দুটি প্যাকেট পাওয়া যায়। প্যাকেটের ওপর তাসনিম নাহিদ ও আল-আমিন, কাশিমপুর লেখা ছিল। ডাকাতি করা এসব টাকা কারাবন্দি দুই জঙ্গি নেতার কাছে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল। আসিফ-এর আগেও ডাকাতির অর্থ কারাগারে শীর্ষ নেতাদের কাছে পাঠিয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত কারারক্ষীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, কাশিমপুর পার্ট-১ এ নব্য জেএমবির প্রধান বিল্লালের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতা রয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির আসামি মোবারক হোসেনের। ফাঁসির আসামিদের বিশেষ সেলে থাকার কথা। কিন্তু মোবারক হোসেন ফাঁসির আসামি হলেও পুরো কারাগার ঘুরে বেড়ান, তার সঙ্গে থাকে বিল্লাল। কারাগারে এই দুজনই প্রভাবশালী। কারাগারের ভেতরে তারা ব্যবসাও করছেন। মোবারকের সহায়তায় বিল্লালের নেতৃত্বে কারাগারের ভেতরে সিগারেট ব্যবসা চলছে। কারাগারের ভেতরে যত সিগারেট যায় এগুলো বিল্লালই দেখাশুনা করেছেন। এই কাজে দুই কারারক্ষীর বিরুদ্ধে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ক্যান্টিন নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন কয়েদি রাইটার নিয়োগও তারাই দিয়ে থাকেন। এই খাত থেকে মাসে কয়েক লাখ টাকা আসে। এ টাকার একটি অংশ কারাগারের বাইরে থাকা বিভিন্ন জঙ্গি ও কারাবন্দি জঙ্গিদের পরিবারের কাছে পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৭ সেপ্টেম্বর ও ২০ সেপ্টেম্বর মোবারকের নামে বড় দুটি লাগেজ যায়। নিয়ম অনুযায়ী লাগেজ পরীক্ষা করার কথা থাকলেও কারাগারের এক শীর্ষ কর্মকর্তার নির্দেশে লাগেজগুলো পরীক্ষা করা হয়নি। এছাড়া গত ২ অক্টোবর কারাগারের ক্যান্টিনে একটি বৈঠক হয়। সেখানে নেতৃত্ব দেয় ফাঁসির আসামি মোবারক হোসেন। সেখানে সবাইকে বার্গার খাওয়ানো হয়, যা ক্যান্টিন রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। কারাগারের ভেতরে থাকা কয়েদিরা একেকজন দুটি করে কম্বল পেলেও মোবারকের সেলে রয়েছে ২৫/৩০ টি কম্বল। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানের ক্ষমতা তালেবানরা নেওয়ার পর গত ১৬ আগস্ট কারাগারে ভোজসভার আয়োজন করা হয়। এসময় কারাগারে থাকা অন্য জঙ্গিরাসহ প্রত্যেককেই বিশেষ খাবার দেওয়া হয়। এই আয়োজনটি করেছিলেন বিল্লাল। আর আয়োজনে যোগ দেয় মোবারক হোসেনসহ জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদি।

করোনাকালীন সময়ে কারাগারে বন্দিদের সাথে দেখা করা নিষিদ্ধ থাকলেও এ নিয়ম মানা হয়নি। বিশেষ করে মোবারক ও বিল্লালের সাথে দেখা করতে আসা ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় দেখা করানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যেভাবে কারাগারের ভেতরে অবাধে জঙ্গিরা ও বিশেষ ফাঁসির আসামিরা বৈঠক করছে তাতে একদিকে কারা নিরাপত্তা, অন্যদিকে তাদের গোপন পরিকল্পনা পৌঁছে যাচ্ছে পলাতক জঙ্গিদের কাছে। এতে কারাগারের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও হুমকির মুখে পড়ছে।

গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল বেশ কয়েকজন জঙ্গি। কারাগার থেকে জঙ্গি নেতারা নাশকতার জন্য পলাতক জঙ্গিদের নির্দেশনা দিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, এরআগে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার নির্দেশনা কারাগারে বসে দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মোগড়া ইউনিয়নের নয়াদিল গ্রামের রাজাকার কমান্ডার মোবারক হোসেনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। আর ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর নারায়ণঞ্জের ফতুল্লা থেকে বিল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কারা কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তাই কারা অভ্যন্তরে থাকা সব জঙ্গি, ফাঁসির আসামিদের আরো নজরদারির মধ্যে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে সিনিয়র জেল সুপার গিয়াস উদ্দীন বলেন, কারাগারের ভেতরে এ ধরনের বৈঠকের সুযোগ খুবই কম। তারপরও যেহেতু এ বিষয় নিয়ে কথা উঠেছে আমি বিষয়টি দেখবো। তিনি দাবি করেন, কারাগারের কারো কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কারা নিরাপত্তা নিয়ে আমরা যথেষ্ট সতর্ক। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মতো এখন আপাতত কিছু ঘটছে না।

কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক তৌহিদ উল ইসলাম বলেন, কারাগারের যে সেলে জঙ্গিরা থাকে, সেখানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সেখান থেকে বাইরে বার্তা বা নির্দেশনা পাঠানোর সুযোগ নেই। এরপরও আমরা মাঝেমধ্যে জানতে পারি কারাগার থেকে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। হয়তো আদালতে পাঠানো হলে তখন কোনোভাবে জঙ্গিরা কাজটি করে থাকতে পারে। তবে তারা যাতে কারাগারে থেকে কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে, সেজন্য আমরা তৎপর রয়েছি।

এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, আইনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে জঙ্গিরা বছরের পর বছর কারাগারেই বন্দি থাকে। বিভিন্ন পন্থায় কারাগার থেকে তারা নিজ নিজ সংগঠনের সদস্যদের বার্তা পাঠানোর খবর প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বাইরের জঙ্গিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃঢ়তায় দুর্বল হয়ে পড়লেও কারাগারে থাকা জঙ্গিরা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও সাক্ষী ও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে জামিনে বের হয়ে কারাগারে থাকা শীর্ষ নেতাদের দেওয়া নির্দেশ পালন করছে অনেকে। এই অপতৎপরতা দমনে দ্রুত বিচার কার্যকর করা, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের এ বিষয়ে আরো গুরুত্ব দেওয়া এবং কারাগারে সংশোধনাগারের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, কারাগারে যে ব্যবস্থায় জঙ্গিদের রাখা হয়, সেখানে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নতুন জঙ্গি তৈরি হওয়া সম্ভব। যেহেতু জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনায় হাতেগোনা কয়েকজনই যথেষ্ট, সেহেতু কারাগারে বন্দি জঙ্গিরাই বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

সিটিটিসির প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার বেশ কয়েকজন জঙ্গির কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে তারা কারাগারে থাকা শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পেত। আবার অনেকে কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে নাশকতায় অংশও নিয়েছে। এটিকে আমরা বড় ধরনের হুমকি মনে করছি না। তবে কারাগারে থেকে যাতে কোনো জঙ্গি তথ্য আদানপ্রদান করতে না পারে, সেদিকে আমাদের নজরদারি রয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads