মুখের হাসি দেখলেই বোঝা যায় কতটা সুখে আছে নীলগঞ্জের কৃষকরা। যে ফসলের মাঠ শীত মেীসুমে এক যুগ আগেও খাঁ খাঁ করতো। সেই মাঠ এখন সবুজের সমারোহ। এক ফসলী জমিতে এখন বারো মাস সবজি চাষাবাদ করে কৃষকরা যেমন স্বাবলম্বী হয়েছে, তেমনি অশিক্ষা দূর হয়ে শিক্ষিত জনপদে পরিণত হয়েছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়ন। লেখাপড়ার পাশাপাশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্ররা পরিবারের পাশাপাশি বাড়ির আঙিনায়, পরিত্যক্ত জমিতে তারা এখন সবজি চাষাবাদ করেছে। সবজি চাষাবাদে রাসায়নিক সার অথবা কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার করছে জৈবসার ও আধুনিক প্রযুক্তি। এ কারণে নীলগঞ্জের সবজির কদর এখন গোটা দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে।
এক ফসল-নির্ভর এখানকার চাষিরা ঘূর্ণিঝড় সিডরের পরই পরিত্যক্ত জমিতে শুরু করেন সবজি চাষ। এতে দিন দিন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। নীলগঞ্জ ইউনয়নের মাঝ দিয়ে প্রবাহমান দশ কিলোমিটার দীর্ঘ পাখি মারা খালে সরকার মিষ্টি পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করায় এ খালের দুই পার জুড়েই এভাবে একেজন কৃষক তার সফলতার গল্প বলা শুরু করেছে শুধু সবজি চাষাবাদ করে। প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেতের ফসল পরিবর্তন করে গত এক যুগ ধরে এভাবেই একটি ইউনিয়নকে সবুজ সবজি গ্রামে রূপ দিয়েছেন নীলগঞ্জের কৃষকরা।
কলাপাড়া কৃষি অফিষের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলায় শীতকালীন শাকসবজি চাষাবাদ হয় ২৫৫০ হেক্টর জমিতে। যার ৮০ ভাগ উৎপাদন হয় নীলগঞ্জ ইউনিয়নে। এছাড়া মরিচ চাষাবাদ হয় ৮৩০ হেক্টর, খেশারী ৩৮০০ হেক্টর, মুগ ডাল ৩৫০০ হেক্টর, ফেলন ডাল ৩৫২০ হেক্টর, বাদাম ৭৫০ হেক্টর, ভ’ট্রা ১২৫০ হেক্টর জমিতে। নীলগঞ্জ ইউনিয়নের চারিদিকে বেড়িবাঁধ থাকায় কোনো দূর্যোগে ফষলের মাঠ প্লাবিত হয় না। এছাড়া পুরনো স্লুইজ গেটগুলো মেরামত করায় পানি নিস্কাশনে কৃষকদের কোন সমস্যা না হওয়ায় লবন পানির ক্ষতি থেকে ফষল রক্ষা করতে পেরেছে কৃষকরা। এছাড়া প্রতিটি সবজি ক্ষেত বেড করে চাষাবাদ করায় কোথাও ভারি বৃষ্টি হলেও এখানকার কৃষকদের ক্ষেত কখনই পানিতে প্লাবিত হয় না, তলিয়ে থাকে না। এ কারণে প্রতিটি সবজি ক্ষেতে সবুজের সমারোহ ও বাম্পার ফলন।
কৃষকরা জানায়, উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রামের চাষিরা প্রথম সবজি চাষাবাদ শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে মজিদপুর, এলেমপুর, নাওভাঙ্গা, আমিরাবাদ, গামুরবুনিয়া, ছলিমপুরসহ প্রাায় দশ গ্রামের ৩০০ চাষী শুরু করেন এ সবজিচাষ। তবে এখন কেবল নীলগঞ্জ ইউনিয়নই নয়, পাশ্ববর্তী মিঠাগঞ্জ, চাকামইয়া, টিয়াখালী, লালুয়া, ধানখালী ইউনিয়নেও শুরু হয়েছে এ চাষাবাদ।
কলাপাড়ার অন্যান্য ইউনিয়নের ধান চাষীরা যেখানে আমন চাষাবাদ করে ধানের দাম নিয়ে পড়েছে বিপাকে, সেখানে শীতের আগাম সবজি চাষ করে এখন ভালো দাম পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠেছে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের সবজি চাষীদের। ফুলকপি,পাতাকপি, বেগুন, টমেটো, ধনিয়াপাতা ও মুলার আগাম চাষ করে প্রতিটি চাষেই তারা লাভের মুখ দেখেছে। এক সবজির ফষল ঘরে তোলার আগেই প্রস্তুত করছে দ্বিতীয় সবজির ক্ষেত। অথচ লবণ পানির কারনে এক যুগ আগেও এই কৃষকদের ফষলের মাঠে শুধু ধান চাষ হতো। কানি প্রতি( ৮০ কড়া) ধান হতো মাত্র ৭০-৮০ মন। প্রতিকানি জমি চাষবাদে তাদের খরচ হতো ২০-৩০ হাজার টাকা। কৃষকদের শ্রমের কারণে সেই একই জমিতে সবজি চাষাবাদ করে এখন ঘরে তুলছে লাখ লাখ টাকা।
কৃষক সুলতান গাজী বলেন, এ বছর মেীসুমের শুরুতেই লক্ষাধিক টাকার ফুলকপি, বেগুন, ধনিয়া পাতা বিক্রি করেছেন। মাত্র ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ করে এ শীতের সবজি চাষাবাদ করেছেন। এখন মাঠে যে সবজি রয়েছে তাও কয়েক লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবেন।
তিনি বলেন, তার বাবার সঙ্গে কাজ করতে করতে এখন শিখে গেছেন কোন সময় কোন ফষল চাষাবাদ করলে লাভবান হওয়া যায়। তাই সব কিছুই আগাম ফলানোর কারণে কলাপাড়া থেকে শুরু করে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের বাজারের ব্যবসায়ীরা তার কাছে শীতের সবজি ক্রয় করতে আসে। তবে কলাপাড়ার কৃষকরা যদি নির্দিষ্ট সবজি বাজারে ফষল বিক্রি করতে পারতো তাহলে আরও লাভবান হতেন তারা। সে ক্ষেতে ক্রেতারাও লাভবান ততো। আর এখন লাভবান হচ্ছে ফড়িয়ারা।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, কলাপাড়ার বিভিন্ন ইউনিয়নের উৎপাদিত সবজি স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে যাচ্ছে। জৈবসারের ব্যবহার বেশি হওয়ায় এখানকার সবজির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে প্রতি মাসে কলাপাড়া থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, গলাচিপাসহ বিভিন্ন বাজারে গড়ে একহাজার টন বিভিন্ন প্রকার সবজি রপ্তানী করেন চাষিরা। প্রতিদিন ভোর হলেই চলে আসে বিভিন্ন উপজেলার পাইকাররা। জমি থেকে ফসল সংগ্রহ করা এবং সাথে সাথে ওজন করে ট্রাক-পিকআপসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে তোলার কাজে এখন ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় সবজিচাষি ও ব্যবসায়ীরা। এ কারণে এসব এলাকার অন্তত ৩০০ সবজিচাষি পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুরে দূর হয়েছে দারিদ্র্য।
কৃষক আবুল কালাম বলেন, বিয়ের পর নতুন সংসারে অল্প টাকা পুঁজি দিয়ে শুরু করেছিলেন সবজি চাষাবাদ। আজ তাকে কলাপাড়ায় এক নামে সফল সবজি চাষী হিসেবে চেনে। সবজি চাষাবাদ করে নিজে লেখাপড়া না জানলেও সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শুরু করে বিদেশী উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরাও তার সবজি ক্ষেত দেখতে আসে। তাদের সবজি চাষাবাদ দেখে এখন গোটা কলাপাড়ার কৃষকরা সবজি চাষে ঝুঁকে পড়েছে।
তিনি বলেন, এ বছর সারা দেশে প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহে শীতকালীন বিভিন্ন ফষলের ক্ষতি হলেও তাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বরং ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে তাদের কৃষি ক্ষেতের কিছুটা ক্ষতি হলেও এবার তা পুষিয়ে উঠতে পেরেছেন বলে জানান।
কৃষকরা জানান, ধান চাষ করে এখন লাভ নেই, বরং টেনশন। একমণ ধান উৎপাদন খরচ যেখানে পাঁচশ টাকার উপরে সেখানে একমন ফুলকপি, বেগুন কিংবা সীম উৎপাদনে খরচ মাত্র দেড়শ-দুইশ টাকা। আর বিক্রিতে আসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। বছরের প্রথম মেীসুমে তারা এই দামে শীতের সবজি বিক্রি করে প্রতি কৃষকই এক থেদে তিন লাথ টাকা পর্যন্ত লাভের মুখ দেখেছেন।
শুধু কী শীতকালীন সবজি এ সবজি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে সবজি চাষাবাদের পাশাপাশি চাষাবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের ফলজ গাছের চাষ। এতে কৃষকরা সবজি বিক্রির পাশাপাশি পেয়ারা, পেপে, ভূট্রা চাষ করে প্রচুর টাকা লাভবান হচ্ছে।
কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল মান্নান জানান, চাষাবাদে বিপ্লব এনেছে নীলগঞ্জের কৃষকরা। এ কারণে উপজেলায় সবজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে এখন দেশের বিভিন্ন বাজারে রপ্তানি করতে পারছে কৃষকরা। তাদের লক্ষ্য, কীটনাশক প্রয়োগের প্রবণতা রোধ করে জৈব সার উৎপাদন ও ক্ষেতে প্রযোগে কৃষকদের উদ্ধুদ্ধ করা। এতে কৃষকরা কলাপাড়ার চাহিদা পূরণ করে ঢাকার বিষমুক্ত সবজির বাজারে যাতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফষল বিক্রি করতে পারে তার ব্যবস্থা করা।