সেরাজুম মনিরা
রাজধানীর কলাকেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে ‘স্বতঃস্ফূর্ত রসায়ন’ শিরোনামে ১২ জন শিল্পীর গ্রুপ প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়েছে ৭ জুন থেকে। যে ১২ জন শিল্পী অংশগ্রহণ করেছে তারা হলেন আফরিদা তানজিম মাহি, আশরাফুন নাহার রুহিন, ইফাত রেজোয়ানা রিয়া, ফারজানা রহমান ববি, জাভেদ জলিল, মুন রহমান, রাশেদুল মানিক, সমীর দত্ত, শিমুল রুরাম, তানভির পারভেজ, ওয়াকিলুর রহমান, ওয়াজউদ্দিন মামুন। প্রদর্শনী সম্পর্কে শিল্পী ও কিউরেটর ওয়াকিলুর রহমান বলেন, ‘স্বত:স্ফূর্ত শৈল্পিক অভিব্যাক্তি’ এমন একটি সৃজনশীল ক্রিয়া যা অন্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা মতবাদ দ্বারা নির্দেশিত, উৎসাহিত নয়। এটি এমন একটি প্রবণতা যা শিল্পীর অভ্যন্তরীণ চাহিদা থেকে চিত্রিত প্রকাশ। এই স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পকর্মটির সাথে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই। এই কারণেই এই শৈল্পিক রূপটির সত্য ও সাদৃশ্য উপস্থাপনার প্রয়োজন হয় না। শিল্পী তার অভিজ্ঞতার, গভীর অনুভূতির সারাংশ শিল্পে প্রকাশ করতে চান। শিল্পী সেই মুহূর্তের মানসিক অবস্থা, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, মেজাজ, চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিফলনের দিকে মনোনিবেশ করেন। তার এই তাৎক্ষণিক সত্য ভাষণ, অভিব্যক্তি শিল্পে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। আদিম শিল্প, শিশুশিল্প, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের শিল্পকর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত। স্বতঃস্ফূর্ততা, মানুষের ভাব প্রকাশের একটি সুন্দরতম উপায়। সভ্যতায় ,ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে বিংশ শতাব্দীর শিল্পীদের প্রিয় এই ধারাটি স্বতন্ত্র, সতেজ, বর্ণিল, সত্য ভাষণে নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় ভরা।
শিল্পী আফরিদা তানজিম মাহি নিজেকেই অবজেক্ট হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং ছবি এঁকে, লিখে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপসকামিতা, ঐতিহ্যগত পরম্পরায় আচ্ছাদিত সামাজিক আচার, বিশ্বাস অবস্থানকে এড়িয়ে, তোয়াক্কা না করে, অস্বীকার করে নগ্নভাবে, সরাসরি প্রকাশ করেছেন। সাহস তাঁর প্রধান শক্তি।
শিমুল রুরাম কলাকেন্দ্রে সহকারী হিসাবে দুই বছরের বেশি সময় সংযুক্ত আছেন। প্রদর্শনী ও শিল্পীদের নানা রকম কাজকর্ম দেখে শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ছবি আঁকার ইচ্ছে তৈরি হয়। নিজের গ্রামীণ শৈশব, সংস্কৃতি ও পরিবেশের মাঝে বেড়ে উঠার অভিজ্ঞতা ও অনুভবের প্রকাশই এ শিল্পীর ছবি।
প্রদর্শনীতে তানভির পারভেজের কাজ দুটি একাত্তর নিয়ে করা। শৈশব থেকে দেখা খবরের কাগজ, বই, ক্লাসের পাঠ, জাদুঘর কিংবা নানান মাধ্যমে দেখা ভিডিও চিত্রের অসহনীয় ইমেজগুলো শিল্পীর ভেতরে তীব্রভাবে একধরনের অনুরণনের সৃষ্টি করে। শিল্পীর দুটি ছবিতেই, একই স্থানে ভার্টিকাল রেখায় ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে ক্যানভাসের হরাইজন্টাল পরিসরের একঘেঁয়েমিতা দূর করার লক্ষ্যে আর পাঠের পুনঃপরিচ্ছেদ হিসেবে।
মুন রহমানের প্রকাশ ভঙ্গি স্বতঃস্ফূর্ত, শিল্পভাবনার বিষয় মানুষ। যে মানুষের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক নয়, আবেগপূর্ণ অভিব্যক্তি হলেও অতি নাটকীয় নয়। এ যেন এ শহর, মানুষের দৃশ্যপট। কঠিন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বাস্তবতায়, শব্দ দূষণে, পরিবেশ দূষণে জীবনযাপন। মেনে নেওয়া আছে, চিৎকারও আছে, তবে শব্দহীন। শঙ্কাহীনভাবে প্রচলিত ব্যাকরণ না জেনে বা না মেনে ক্যানভাসে, কাগজে দৃশ্যপট তৈরি করেন তিনি। সরলতায়, স্পষ্টতায়, বলিষ্ঠতায় যা উপস্থাপিত হয়, তা বিমূর্ত ধাঁচের ছবির কাছাকাছি। ইঙ্গিতময় ও সাংকেতিক ভাষায় কথা বলে। মুনের প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার অভিজ্ঞতা নেই। শিল্পের ইতিহাস, বাজার, গ্যালারি, প্রদর্শনী, কিউরেটর, সমালোচক বোঝেন না, চেনেন না-তবে চোখ আছে, দেখে পড়তে পারেন। আছে অনুভুতি, বুদ্ধি, বোধ এবং চিত্র তৈরির তাড়না।
প্রদর্শনী চলবে ৩০ জুন পর্যন্ত।





