আরো একটি জঘন্য ধর্মঘট প্রত্যক্ষ করল বাংলাদেশের মানুষ। পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতিতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হলো বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে। ধর্মঘটি শ্রমিকদের হাতে লাঞ্ছিত ও অসম্মানিত হয়েছেন অনেকে। এই অমানুষিক ধর্মঘট মায়ের বুক থেকে কেড়ে নিয়েছে সাতদিনের অসুস্থ শিশুসন্তানকে। ওই শিশুর অসহায় পিতা-মাতার শত অনুরোধ উপরোধে কর্ণপাত করেনি ধর্মঘটি শ্রমিকরা। এই নিষ্পাপ শিশুটিকে কার্যত হত্যা করা হয়েছে ধর্মঘটের নামে। বলা হয়ে থাকে, ধর্ম বা ন্যায়ের জন্য যে ঘটনা, সেটাই ধর্মঘট। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতির দুই দিন রাজধানীসহ সারা দেশে যা সব কাণ্ড ঘটে গেল, তার কোনটা ন্যায় ধর্মের সমার্থক! শিশু হত্যার চাইতে অধর্ম আর কি হতে পারে! কী পরিস্থিতিতে রুগ্ণ শিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, সে সংবাদ কমবেশি সবাই ইতোমধ্যে জেনে গেছেন। ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অনেকে এই ধর্মঘটের জন্য নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের দিকে আঙুল তুলছেন। ধর্মঘট চলাকালে শ্রমিকরা প্রাইভেটকারের ড্রাইভার, যাত্রী, সাধারণ পথচারী এমনকি শিক্ষার্থী মেয়েদের পর্যন্ত হেনস্তা করতে ছাড়েননি। অনেকের মুখে মবিল মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেইসব ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে, ফেসবুকেও দেওয়া হয়েছে। পরিবহন শ্রমিক নেতারা বলেছেন, যারা এসব কাজ করছে, তাদের সঙ্গে কর্মবিরতির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা কি তাহলে আসমান থেকে নাজেল হলো! বিরোধী দল যখনই কোনো কর্মসূচি দেয়, তখনই আমাদের পুলিশ বাহিনীকে অতি সতর্ক ও সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায়। বেপরোয়া বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা যখন রাজপথে নেমে এসেছিল, তারা যখন নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সড়কে যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনয়নের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল, তখনো পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। দরকারমতো ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকরা যখন লোকের মুখে পোড়া মবিল মাখিয়ে দিল, পথে পথে অ্যাম্বুলেন্স আটকে দিয়ে শিশু হত্যা করা হলো, পুলিশ তখন বাধা দিতে এলো না। এ নিয়ে ফেসবুকেও দেখেছি অনেকে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলতে চাইছেন যে, ডাল ম্যা কুচ কালা হ্যায়। আমরা এই আলোচনায় আর এগুতে চাই না। আমাদের বলার বিষয়ও এটা নয়।
আসলে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতি— সবকিছুই যেন বা ছন্দহীন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে, যেন বা পথ হারিয়েছে। ছাত্ররাজনীতি তার ঐতিহ্য হারিয়ে নিঃস্বপ্রায়। বুদ্ধিবৃত্তির জগতে মুক্তচিন্তার পথ আজ কণ্টকাকীর্ণ। কমিটমেন্টের জায়গা থেকে দূরে সরে এসেছে রাজনীতি। আদর্শহীনতা রাজনীতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে অনেকটাই। উজ্জ্বল ঐতিহ্য ছিল বাংলাদেশের কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের। ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী সংগ্রামে উপমহাদেশের কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর যে কী অসাধারণ ভূমিকা ছিল, তা ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই জানেন। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা এবং বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের শ্রমিক সমাজ পালন করে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় শ্রমিক সমাজ বহু আগে থেকেই বড় শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। বিশ্বের যত মহৎ ও সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে শ্রমিক ও কৃষকরাই পালন করেছেন অগ্রগণ্য ভূমিকা। শ্রমিক সমাজের কষ্ট-ক্লান্ত জীবনের কী নিরুপম প্রাণবন্ত ছবিই না এঁকে গেছেন ম্যাক্সিম গোর্কি তার ‘মাদার’ উপন্যাসের পাতায় পাতায়। কিশোর কবি সুকান্ত, বিদ্রোহী নজরুল, সুভাষের মতো মহান কবিরা তাদের কবিতার ছত্রে ও ছন্দে কতই না মহিমান্বিত করে গেছেন শ্রমিক সমাজকে! সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বলয়ের বিপ্লব-সংগ্রাম ছাড়াও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও শ্রমিক সমাজের অবদান অনস্বীকার্য। শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিকরা জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন মেহনতি মানুষের সর্বজনীন অধিকার। মেহনতি মানুষের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য প্রতিবছর দুনিয়াজুড়ে পালিত হয় মহান মে দিবস। শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বস্তরের মানুষই আজ সোচ্চার। শ্রমিকের অধিকার মানেই তো সাধারণ মানুষের অধিকার। যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মেহনতি মানুষের শ্রম শোষণ করে সম্পদের পাহাড় তৈরি করে চলেছেন, তারা ছাড়া সবাই তো আসলে শ্রমিক। যখন আমরা গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিই- দুনিয়ার মজদুর এক হও, তখন তো প্রকারান্তরে বিশ্ব মানবতার ঐক্যেরই ডাক দেওয়া হয়। এই শ্রমিক সমাজ কোনো দিনই সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ ছিলেন না। আমাদের দেশেও বহু জননন্দিত নেতার জন্ম দিয়েছেন চাষি-মজদুর সমাজ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হয়ে ওঠেন কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মনু মিয়াও একজন শ্রমিক। ষাট দশকে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে টঙ্গি, নারায়ণগঞ্জ ও তেজগাঁওয়ের শ্রমিকরা যে ত্যাগ-সুন্দর ভূমিকা পালন করেন, তা কখনোই বিস্মৃত হওয়ার নয়। কলের শ্রমিক, ঘাটের শ্রমিক, রাজপথের শ্রমিক, মাঠের শ্রমিক কেউই জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। স্বাধীনতার পরেও প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শ্রমিক সমাজ জনগণের সঙ্গেই ছিল।
কিন্তু আজ আমাদের একি হলো! শ্রমিক সমাজের কোনো কোনো অংশকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের বিপক্ষে। নিজেদের দাবি আদায়ের নামে তারা শত্রু বানিয়ে নিয়েছেন তাদেরই ভাই, তাদেরই পিতামাতা ও পরমাত্মীয় জনসাধারণকে। তারা এখন পথে নামে মুখে কালি মাখিয়ে দেওয়ার জন্য। তারা শিশু হত্যা করে। তারা মানুষ মারার অধিকার দাবি করে। যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবি আদায় করার জন্য ধর্মঘট করার অধিকার রয়েছে। সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার রয়েছে, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার রয়েছে। এসব অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের শাসনতন্ত্রেও এসব অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু জুলুম করার অধিকার নেই। আর জনসাধারণকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেওয়ার সামান্যতম সুযোগও নেই। কর্মবিরতি বা ধর্মঘট যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের সর্বশেষ অস্ত্র। দাবি আদায়ের জন্যে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ প্রদর্শন, মানববন্ধন, কালোব্যাজ ধারণ, স্মারকলিপি প্রদান- এরকম হাজারটা নিয়মতান্ত্রিক পথ খোলা রয়েছে। তা নয়, পরিবহন শ্রমিক নেতারা হুট করে ডাক দিয়ে বসলেন কর্মবিরতির। যা হোক, নিয়মকানুন উপেক্ষা করে ধর্মঘট ডেকেছেন তো বেশ করেছেন। জনগণের কষ্ট হয় হোক, সেটাও না হয় মেনে নেওয়া গেল। শান্তিপূর্ণভাবে নিজেরা নিজেদের কর্মসূচি পালন করে দেশবাসীকে উদ্ধার করুন। তাই বলে জনসাধারণকে অত্যাচার করবেন, তাদের ওপর গুণ্ডামি করবেন। পরিবহন শ্রমিকরা তো স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেও কোনো শিক্ষা নিল না। এই তো সেদিনের কথা, শতসহস্র ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরে রাস্তায় গণপরিবহনের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে, সহপাঠী হত্যার বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। কিন্তু তারা কি কাউকে অপদস্থ করেছিল! সহপাঠী হত্যার প্রথম দিনের হিট অব দ্য মোমেন্টের ভাঙচুরের পরে তারা কি একটি গাড়িও ভাঙচুর করেছে! বিক্ষোভের সেই কটি দিন মানুষ অনেক কষ্ট করেছেন। পায়ে হেঁটে দূরে অফিস করেছেন। সবই করেছেন খুশি মনে। নিয়মের পথে যে আন্দোলন, সে আন্দোলনের জন্য কষ্ট স্বীকার করে নিতে কারো গায়ে লাগেনি। পক্ষান্তরে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনে সারা দেশের মানুষ বিরক্ত-বিক্ষুব্ধ। লোকে ধিক্কার দিচ্ছেন এই কর্মবিরতির নামে স্বেচ্ছাচারিতাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অনেকে লিখেছেন, মূর্খের দল এর চাইতে ভালো কিছু করতে পারে না। পরিবহন শ্রমিকদের মূর্খ বলে তিরস্কার করা হচ্ছে। এই তিরস্কার এদের গায়ে লাগবে, এমনটি আশা করা দুরাশার নামান্তর। বাংলাদেশের মেহনতি মানুষজনের বেশিরভাগই নিরক্ষর অথবা স্বল্পশিক্ষিত। অতীতেও তা-ই ছিল। নিরক্ষর ও মূর্খের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে। মূর্খ তারাই, যাদের মধ্যে সভ্যতা-বভ্যতার লেশমাত্র নেই। চালচলনে স্থূল অমার্জিত। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এরা অসভ্য। সভ্যতার কোনো শিক্ষাই মন-মগজে প্রবেশ করেনি। এ ধরনের মূর্খ লোকের ক্ষেত্রবিশেষে একাডেমিক সার্টিফিকেটও থাকতে পারে, পোশাক-আশাকে তারা কেতাদুরস্ত হতে পারেন। পরিবহনের যে শ্রমিকরা মানুষকে অপদস্থ করেছে, তারা যে সত্যিকার অর্থেই মূর্খ, তাতে সন্দেহ কী! মূর্খতার এই বৃত্ত থেকে মেহনতি মানুষকে বের করে আনা জরুরি। কিন্তু কে নেবে সেই দায়িত্বভার! এই কর্তব্যের ভার সবার আগে কী তাদের কাঁধেই বর্তায় না, যারা শ্রমিকদের নেতৃত্ব দেন?
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
saleheenfa@gmail.com