করোনা মোকাবিলায় এই বাজেট কতটুকু উপযোগী

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

করোনা মোকাবিলায় এই বাজেট কতটুকু উপযোগী

  • প্রকাশিত ১৪ জুন, ২০২১

মো মারুফ মজুমদার

‘জীবন ও জীবিকার প্রাধান্য, আগামীর বাংলাদেশ’— এই স্লোগানকে সামনে রেখে উত্থাপিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট। চলমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দিয়ে গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

সরকারের মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে যা ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় বা অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। করোনা মহামারীর ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। চলতি বছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। সে তুলনায় এবারের বাজেটে পরিচালন ব্যয় বাড়বে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর আবর্তক ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ছয় হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।

এই বাজেটে  মোট আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে আয় বাড়ছে ১১ হাজার কোটি টাকা। মোট আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও এনবিআরকে একই পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া রয়েছে। প্রথমবারের মতো এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে না। এছাড়া আগামী বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হচ্ছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বাজেটে প্রবৃদ্ধির এই হার ধরা হয় ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়াও  মোট জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এদিকে করোনার কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে মানুষের হাতে টাকার সরবরাহও কমেছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয়ই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বাজেটে  মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করেছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত ঘাটতি বাজেট দিয়ে থাকে। বাংলাদেশও প্রতি অর্থবছর ঘাটতি বাজেট দেয়। করোনা ভাইরাসের কারণে এই ঘাটতি এবার আগের সব সীমা অতিক্রম করেছে। এই বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বাজেটে তা ৬ দশমিক ১ শতাংশ। ঘাটতির পরিমাণ ধরা হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। আর জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা। বাজেটে বিদেশি উৎস  থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।

এই বাজেটে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে ব্যবসায়ীমহল। করপোরেট হার কমানো হয়েছে, সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে স্থানীয় শিল্পকে। হ্রাস পেয়েছে ব্যবসায়িক টার্ন ওভারও। তবে যারা সাধারণ, মধ্যবিত্ত রয়েছে তাদের জন্য তেমন ছাড় নেই। এমনকি বর্তমান করোনাকালীন সময়ে যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, তাদের কথাও বাজেটের কোথাও বলা নাই। জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বেশি দেওয়ার দরকার ছিল। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেড়েছে।

অর্থমন্ত্রী স্বাস্থ্য খাতে তুলনামূলক বেশি বরাদ্দ দিয়েছেন। কিন্তু সেই বরাদ্দ যে যথাযথভাবে ব্যয় হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। চলতি অর্থবছরেও স্বাস্থ্য খাতে বেশি বরাদ্দ ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অবহেলা, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতামূলক আচরণের জন্যে তা ব্যয় করা যায়নি।  অর্থমন্ত্রী ১০ কোটি মানুষকে করোনার টিকার আওতায় আনার কথা বলেছেন। কিন্তু মাসে ২৫ লাখ লোককে টিকা দিলে এই কর্মসূচি শেষ করতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এই সময়ের মধ্যে আরো কয়েক কোটি মানুষ নতুন করে টিকার উপযুক্ত হবেন। অর্থমন্ত্রী কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলেছেন, যাতে তারা দেশের ভেতরে বা বাইরে গিয়ে উপযুক্ত কাজ পেতে পারেন। অর্থমন্ত্রী কৃষির উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু এই খাতে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।

একইভাবে বাজেটে করোনাকালে শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দিকনির্দেশনা নেই; যদিও বরাদ্দ কিছু বেড়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ১৫ শতাংশ কর প্রস্তাব শিক্ষাকে আরও সংকুচিত করবে। এই খাতে টাকা অঙ্কে বাড়লেও জিডিপির হিসেবে বরাদ্দ কমেছে। জিডিপি ও বাজেটের অংশ হিসেবে গত অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ২.২৪ শতাংশ এবং ১২.২৮ শতাংশ। কিন্তু তা এবারে কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২.০৮ এবং ১১.৯২ শতাংশ। এই খাতের এত বড় ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই এই বাজেটে।

করোনাকালে যেসব খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। কেমন হলো বাজেট ২০২১-২২ শিরোনামে ওয়েবিনার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এমএফএসের ওপর করপোরেট কর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যেটি এখন আছে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ওপর করপোরেট কর বাড়ানোর প্রস্তাব সময়োপযোগী নয়। অনেকে বলেন, এই কর তো কোম্পানিগুলো দেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো দিন শেষে এটা গ্রাহকের ঘাড়েই চাপাবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর কর বাড়ানো যৌক্তিক নয় বলে মনে করে উন্নয়ন সমন্বয়। তিনি আরো বলেন, টাকা নয়, টিকাই এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। প্রবৃদ্ধি, ঘাটতি অর্থায়ন এগুলোর চেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত কীভাবে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষকে দ্রুত টিকা দেওয়া যায়। টিকা পেলেই মানুষ স্বস্তি পাবে। ব্যবসায়ীরা আস্থা পাবে।

করোনাকালীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে খাতগুলো রয়েছে— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা খাত, তাতে আশানুরূপ বাজেট বরাদ্দ করা হয়নি। যা করা হয়েছে তার কতভাগ বাস্তবায়িত হবে তা অনিশ্চিত। এতে করে মধ্যবিত্ত, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কতটুকু সুখের হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাজেট পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্ট কাঠামো অবলম্বন না করায় ধনী আরো ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্রতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ করোনা মোকাবিলায় সারা বিশ্ব যখন সম্প্রসারণশীল নীতির দিকে ঝুঁকছে, আমাদের দেশ সেখানে সংকোচন নীতি অবলম্বন করছে। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার সঠিক ব্যবস্থা করাই হতো এই বাজেটের উপলক্ষ। গতানুগতিক বাজেটে  জনমানুষের অর্থনৈতিক সংকট নয়, প্রবৃদ্ধিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি, বাজেটের সর্বজনীন  খাতগুলো যেন উপেক্ষিত থেকেই গেল।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads