মো. আরাফাত হোসেন
প্রকৃতিতে শীত বিভিন্ন উৎসব নিয়ে এলেও ঢাকাতে শীত আসে বায়ুদূষণের অভিশাপ নিয়ে। শুষ্ক মৌসুমে রাজধানী বায়ুদূষণে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে। আর এবার বায়ুদূষণ মোটেই এই মহামারীর সময়ে কাঙ্ক্ষিত নয়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সবাই যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন নীরব ঘাতক হিসেবে বায়ুদূষণের আগমন কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয় ।
উদাহরণ হিসেবে বিবিসি বাংলার একটি তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরছি— বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার একটি গ্রাম কল্যাণপুরের বাসিন্দাদের বেশিরভাগই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত, যে গ্রামটিতে বিদ্যুৎ এসেছে কিছুদিন আগে। এই গ্রামের একজন বাসিন্দা মো. হারুন অর রশিদ বলছেন, পাঁচ বছর আগেও যেখানে তাদের গ্রামের বাতাস অনেকটা পরিষ্কার বলে মনে হতো, সেখানে কয়েক বছর আগে আশপাশে কয়েকটি ইটভাটা তৈরি হওয়ার পর থেকে যেন বাতাস অনেকটা বদলে গেছে।
তিনি বলছেন, আশপাশে ইটের ভাটা হওয়ার পর ভাটাওয়ালারা মাটি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আবার তারা যে ইট পোড়ায় তাতে কালো ধোঁয়া বের হয়। এসব ভাটায় সারাক্ষণ ইঞ্জিনের গাড়ি যাতায়াত করে, সেগুলো থেকেও সারাক্ষণ ধোঁয়া বের হয়, শব্দ হয়। আমাদের গ্রামের বাতাসটা যেন মনে হয় আগের চেয়ে ভারী হয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, গ্রামের মানুষের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার কষ্ট বা কাশি বাড়ার মতো সমস্যাও দেখা যাচ্ছে।
শুধু গ্রামেই নয়, বায়ুদূষণের এই সমস্যা এখন সমগ্র বাংলাদেশের। বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’-এর প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ কোনো দূষিত এলাকায় বাস করে। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ আর ভারত ও চীনে মারা যাচ্ছে ১২ লাখ মানুষ।
সুতরাং বায়ুদূষণ থেকে সৃষ্ট সমস্যা সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন অসুখের সাথে করোনার সমন্বয়ে জনসাধারণ ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে। বিশ্লেষকদের মতে, শীত মৌসুমে যেহেতু স্বভাবত রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে এবং তাই তার সাথে করোনা মিলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করবে। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাবে ব্যাপক হারে। এমন অবস্থা নাগরিক জীবনের জন্য অবশ্যই সুুুুখকর নয়। প্রত্যেক বছরই শীতে ঢাকার অবস্থা একই রকম থাকে, কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন করোনা পরিস্থিতির কারণে।
ঢাকাতে বর্তমানে বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অবকাঠামো নির্মাণকাজ, যানবাহন নির্গত বায়ু এবং চারপাশের ইটের ভাটা। রাজধানী ঢাকা এই ঝুঁকিতে আছে সব থেকে বেশি। ঢাকার বায়ুতে বিদ্যমান সিসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, দস্তাসহ ইত্যাদি ভারী ধাতুর উপস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে বেশি যা শ্বাসকষ্ট থেকে ক্যানসার পর্যন্ত বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী। বাতাসের মান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী গত বছর নভেম্বরের বিভিন্ন সময়ে ঢাকার বায়ু বিশ্বের সব থেকে বেশি দূষিত বায়ু ছিল। সাধারণত রাজধানী ঢাকাকে বায়ুদূষণে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে দেখা যায়। করোনাকালে কয়েক মাস ঢাকা শহর অচল থাকার সময়ে ঢাকার পরিবেশে বায়ুর অস্বাভাবিক উন্নতি লক্ষ করা যায়। সে সময় বাতাসে দূষণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল, যা এখন আবার অবনতির দিকে।
দূষণ মোকাবিলায় প্রত্যেক বছর সিটি করপোরেশন যে ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে থাকে তা পর্যাপ্ত নয়, অনেকটা ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’র মতো। কয়েকবার জল ছিটানোতে সমস্যার সমাধান মিলবে না, নগর পরিকল্পনাবিদদের উচিত সময়োপযোগী উদ্যোগ নেওয়া। অবকাঠামোগত নির্মাণ ও চারপাশের ইটের ভাটা থেকে যেহেতু উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দূষণ ঘটে তাই সেখানে প্রয়োজন স্থায়ী নীতিমালার। পাশাপাশি বর্তমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বায়ুদূষণকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। শুধু করোনাকালে নয়, বায়ুদূষণ থেকে ঢাকাকে সব সময়ের জন্য নিরাপদ করতে হবে। নিরাপদ বাসযোগ্য নগরী গড়তে বায়ুদূষণ সমস্যার সমাধানের বিকল্প নেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়