শাকিবুল হাসান
দেশে গত বছরের মার্চ থেকে করোনার প্রাদুর্ভাবে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রথমদিকে সংক্রমণের হার কম হলেও সম্প্রতি দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিনই আগের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ শনাক্ত ও মৃত্যু হচ্ছে। এর পাশাপাশি করোনার উপসর্গে প্রাণহানির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় দশ লাখের মতো। আর মারা গেছে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি। চলতি মাসের শুরু থেকে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা একশর ওপরে। গত দু-তিন মাস আগেও শহরের তুলনায় গ্রামে করোনার প্রকোপটা কম ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সরকারের পর্যায়ক্রমে বিধিনিষেধ আরোপের কারণে অনেকে কাজ ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। ফলে তারা নিজেদের অজান্তেই ভাইরাস বহন করে শহর থেকে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ তুলনামূলক কম সচেতন এবং কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হওয়ায় করোনা ভাইরাস শহরের তুলনায় গ্রামে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বর্তামানে দেশের মোট শনাক্তের ৫০ শতাংশেরও বেশি গ্রামের। গ্রামের মানুষজন করোনার স্বাভাবিক লক্ষ্মণ যেমন— জ্বরসর্দি, বুকে ব্যথা, কাশি, গলা ব্যথা, পেটের সমস্যা ইত্যাদিকে মৌসুমি রোগ বা অসুস্থতা ভেবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাছাড়া গ্রামের মানুষের অজ্ঞতার কারণে তারা বাড়ির বাইরে কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই চলছেন। ফলে তারা একজন আরেকজনকে করোনার ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এমনকি, করোনার প্রাথমিক উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা করাচ্ছেন না। এ অবস্থায় সরকারের উচিত গ্রামের স্থানীয় সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া যেন গ্রামে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাছাড়া শহরের পাশাপাশি দেশের সমস্ত উপজেলায় বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের মানুষকে করোনা পরীক্ষায় উৎসাহিত করতে হবে। কেননা যত বেশি পরীক্ষা করা হবে, করোনার প্রভাবটা তত পরিষ্কার হবে। পাশাপাশি গ্রামেও করোনার টিকা গণহারে প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশে ৮৭ হাজারের বেশি গ্রাম রয়েছে এবং দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশই গ্রামে বসবাস করে। সুতরাং দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি এবং টিকার আওতায় আনতে পারলে দেশে করোনার সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হবে এবং তখন করোনা প্রতিরোধও আমাদের জন্য সহজ হবে।
কিন্তু এর জন্যে প্রয়োজন সুপরিকল্পিত কার্যক্রম। গ্রামে দারিদ্র্যের হার বেশি। তাই গ্রামগুলোতে বিধিনিষেধ আরোপের আগে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা দরকার, পেটের ক্ষুধার কাছে ভাইরাস বা সরকারের নির্দেশনা অর্থহীন হয়ে পড়ে। সরকার এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিলেও তা যথেষ্ট নয় বা অনেকাংশে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই সুষ্ঠু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে মানসম্মত করা এবং গ্রামের মানুষের প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুগম করতে হবে। তাই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ঘাটতিগুলো পূরণ করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো দক্ষ জনশক্তি দ্বারা পরিচালিত করতে হবে। গ্রামের মানুষকে করোনার প্রাথমিক উপসর্গগুলোর বিষয়ে সচেতন করতে হবে। করোনা নিয়ে কুসংস্কার বা আতঙ্ক ছড়ানো থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। কেননা গ্রামের মানুষদের মধ্যে এসব বিষয়ে উৎসাহ অনেক বেশি। বিনা কারণে বাড়ির বাইরে বের হতে সবাইকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সচেতনতাও খুব জরুরি। কেননা তারা জানেই না যে, নিজে আক্রান্ত না হলেও নিজের মাধ্যমে বহন করে অন্যের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে গ্রামে সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।
সমপ্রতি বাংলাদেশে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই বেড়েছে। গবেষণা শেষে বিজ্ঞানীরা বলছেন, একেকজন সংক্রমিত ব্যক্তি রোগটি গড়ে ১.৪ থেকে ২.৫ জন ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটি এখন নিশ্চিত যে, এটি এমন একটি ভাইরাস যা নিজে থেকে বিনষ্ট বা বিলুপ্ত হবে না। উদ্বেগের বিষয় হলো, রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই এমন ব্যক্তিরাও এ ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই এ ব্যাপারে নিজেদের যথেষ্ট সচেতন থাকতে হবে। নিজের জন্য না হলেও নিজের পরিবারের এবং সমগ্র জাতির কথা ভেবে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেও আমরা এই প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি। সবশেষে বলতে চাই, করোনার প্রকোপ থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বে আবারও শান্তি ফিরবে, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : নিবন্ধকার