বাংলাদেশে রেলগাড়ি চালু হয়েছিল ১৮৬২ সাল থেকে। ইংরেজরা তখন বাংলা-ভারত শাসন করছে। কিন্তু সেই প্রাথমিক যুগেই রেলগাড়িতে নারীদের জন্য ‘আলাদা বগি’ দাবি করে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছিল। নারীদের অগ্রাধিকারের বিষয়টি দুইশ বছর আগে থেকেই চলে আসছিল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সেদিনের ‘ঢাকা প্রকাশ’ এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ১৮৬৯ সালের ২৩ মে সংখ্যায় ‘ঢাকা প্রকাশ’ রেলগাড়িতে যাতে নারীর জন্য স্বতন্ত্র বগি রাখা হয় তার দাবিতে বিস্তারিত দফা প্রকাশ করে।
এ বিষয়টি এখানে উল্লেখ করলাম এজন্য যে, নারী ও শিশুর জন্য অগ্রাধিকারের দাবিটি আজকের নয়। আমাদের দেশেও অনেক আগে থেকেই এ নিয়ে সংগ্রাম চলে আসছে। রাষ্ট্র, সমাজ, সংসার কোনো কোনোটার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে, আবার অনেক কিছুকে পাত্তাই দিচ্ছে না। সম্প্রতি করোনাভাইরাস বিষয়ে জাতিসংঘ তার হতাশা ব্যক্ত করে বলেছে, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ করোনা মহামারীর বিভিন্ন ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে নারীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
মহামারী নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের উদ্যোগগুলো জাতিসংঘ বিশ্লেষণ করে দেখেছে। এতে দেখা যায়, বিশ্বের ২০৬টি দেশ নারীদের প্রতি এসময়ে যে সহিংসতা হয়েছে তার যৌক্তিক সমাধান করেছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব দেশে নারীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষাও জোরদার হয়েছে। এতে নারীদের প্রতি সুরক্ষা সামাজিক প্রতিশ্রুতি পালিত হয়েছে বলে আমরা বলতে পারি।
কিন্তু ৪২টি দেশ নারীদের সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা নেয়নি অথবা নিতে পারেনি। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে অনেক উন্নত ও ইউরোপীয় দেশের সমালোচনা রয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, এসব দেশ সহিংসতা শিকার নারীদের সহায়তার জন্য পদক্ষেপ নিলেও বর্তমান করোনা মহামারীতে নারীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষায় তাদের কোনো উদ্যোগ ছিল না। আমরা এ ব্যাপারে স্বস্তি প্রকাশ করতে পারি যে, করোনাকালে বাংলাদেশ এসব বিষয়ে দৃঢ় ভূমিকা পালন করেছে। করোনার ক্ষতিগুলো যাতে নারীদের জন্য সহনীয় হয়, তার জন্য সরকারের পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, দুনিয়ার অনেক দেশেই করোনাকালে ঘরে-বাইরে নারীদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৩৫টি দেশের কথা আমরা বলতে পারব, যেখানে নারীদের প্রতি এসময়ে ঘটে যাওয়া সহিংসতার বিরুদ্ধে হেল্পলাইন চালু হয়েছিল, বাংলাদেশ যার অন্যতম।
প্রথম থেকেই জাতিসংঘ বলে আসছিল, করোনা মহামারীর প্রভাবে প্রধানভাবে নারীদের মধ্যে গরিবানা বেড়ে যাবে। আর সেটা শেষ পর্যন্ত ঘটেছেও। পুরুষদের তুলনায় নারীদের কর্মসংস্থান করোনাকালে বেশি সংকটাপন্ন হয়েছে। শহর এলাকায় বিপুল সংখ্যক নারী গৃহকর্মী কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এটা আর বেশিদিন চললে একটা খুব খারাপ নজির হয়ে যাবে। কীভাবে নারী গৃহকর্মীরা আবার কাজে ফিরে আসতে পারে, সুরক্ষা নিয়ে যেসব গবেষক কাজ করছেন, তারা এ বিষয়ে একটি পথ অবশ্যই বাতলে দেবেন।
আমাদের দেশের সরকার ও সামাজিকদের সমন্বয় এ ব্যাপারে ইতিবাচক ফল দিচ্ছে। করোনাকালে নারীদের সুরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সুফল বয়ে আনবে। অপেক্ষাকৃত সম্বলহীন মানুষ যাতে এর ফল ভোগ করতে পারে তার জন্য আমাদের সচেতনতা জরুরি। অর্থনৈতিক সুরক্ষার পাশাপাশি নানা প্রকার সহিংসতার প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়েও নারীরা যাতে অগ্রাধিকার পায় তার জন্য আমাদের সুযোগগুলোকে সর্বাধিক ব্যবহার করতে হবে।
আমাদের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে মাল্টিসেন্টারাল নানা কর্মসূচি রয়েছে, যার ১১টি প্রকল্প পরিচালিত হয় হাসপাতালে। এবছর এ করোনাকালে এখানে সেবা নিয়েছেন হাজার নারী ভুক্তভোগী। সেপ্টেম্বর, ২০২০-এ প্রকাশিত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি জরিপে দেখা যায়, করোনাকালে এ বছর প্রথম আট মাসে ৮৯৯ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছিল। সহিংসতাগুলো শারীরিক-মানসিক দুদিক থেকেই ছিল। এর বিরুদ্ধে সরকারি উদ্যোগগুলো আছে এবং থাকবে। কিন্তু আমরা সামাজিকভাবে এবং পারিবারিকভাবে এগুলোর মোকাবিলা করার কথা চিন্তা না করলে ফলপ্রসূ কিছু ঘটবে না।
সামাজিক ও পারিবারিক সুরক্ষাগুলো আমাদের ব্যক্তিজীবনে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষভাবে এটা প্রভাব ফেলে শিশু-কিশোরদের জীবনে। ছোটবেলা থেকেই সে যখন দেখবে তার পরিবারে নৈতিকতার আদর্শ চলে তখন তার মানসিক গড়নটি সেভাবেই বিকশিত হয়। বর্তমানকালের শিশু-কিশোররা সরাসরি সমালোচনা খুব বেশি নিতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন অভিভাবকদের আবেগনির্ভর দরদ ও ভালোবাসা। বলা যায়, ‘আমাদের কালে আমরা একাজগুলো এভাবে করেছি।’ সমাজে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাগুলো, যা তার বিরুদ্ধেও ঘটছে, তার প্রতি তাকে সহিংস না করে সহনশীল ও ধৈর্য শিক্ষা দেওয়া, যাতে সেও পাল্টা একটি নিষ্ঠুর আচরণ করে না ফেলে।
বাংলাদেশের প্রতি চারজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর একজন কিশোর বালক অথবা বালিকা। এরা পরস্পর যে কেউ যে কাউকে প্রভাবিত করে ফেলতে পারে। এ প্রভাবে পড়ে অনেক সময় আবেগের বশে এমন সব ছবি পাঠিয়ে ফেলে যা তাকে আত্মহত্যার ইশারা দেয়। ইন্টারনেটে এরকম অনেক ঘটনার কথাই এখন প্রতিদিন আমাদের সামনে আসছে। করোনাকালে এখন এসব ঘটনা বেড়ে গেছে, কারণ স্কুল-কলেজ বন্ধ, কাজ নেই, অবসর জীবন, এই সময়টায় শিশু-কিশোররা ভুল নগ্ন পথে পা ফেলছে।
তাদের বাঁচাবে কে? করোনাকালে এবং করোনাকালের বাইরে আমাদের অভিভাবক, আমাদের গণমাধ্যম, আমাদের সামাজিক নেটগুলো যা করতে পারত, তা কি তারা করতে পারছে। ৩ অক্টোবর ২০২০ তারিখে বাংলাদেশের একটি প্রধান দৈনিক ভেতরের পাতায় একটি সংবাদ ছেপেছে, দিনটি প্রেমিকদের শিরোনাম করে। পত্রিকাটি তারপর শেষে আরো বিস্তারিত লিখেছে, ‘আজ ৩ অক্টোবর বয়ফ্রেন্ড দিবস। ইন্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র বলছে, ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু হয় দিবসটির। ২০১৬ সাল থেকে এটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। বর্তমানে বিশ্বজুড়েই দিনটি বেশ সমাদৃত হচ্ছে।’
পরদিন আমার মোবাইল ফোনে পরপর দুটো ম্যাসেজ পেলাম ফোন কোম্পানি থেকে ‘ভালোবাসা—প্রেমের টিপ্স পেতে ডায়াল করুন .. .. .. এত নম্বরে। চার্জ ২.৬৭ টাকা। এ দেখে মনে পড়ল, আশির দশকের শুরুতে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রথম চালু করেছিল ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’। আমরা দেখছি এখন এর বিকৃত রূপ ও কুপ্রভাব শিশু-কিশোর থেকে তরুণ-তরুণীদের খেয়ে ফেলছে।
ভালোবাসা-প্রেমের টিপ্স বিক্রি করছে মোবাইল কোম্পানিগুলো। সংবাদপত্র চালু করতে চাচ্ছে ‘বয়ফেন্ড দিবস’, এর আগে সংবাদপত্র চালু করেছিল ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’। এগুলো আমাদের সমাজে যে কুপ্রভাব ফেলছে তার দায় থেকে আমরা কি মুক্তি পাব? সামপ্রতিক সময়ে বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যার দায়ে তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। আদালত মামলার পর্যবেক্ষণে বলেছে, ‘আয়শার সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে অন্য মেয়েরাও বিপথগামী হবে’। আয়শার বিপথগামীতার জন্য দায়ী কি একমাত্র আয়শাই, আয়শা সামাজিক মাধ্যমে অন্যের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল অন্য তরুণের সঙ্গে, যেরকম সম্পর্ক গড়ার জন্য সংবাদপত্র ও মোবাইল কোম্পানিগুলো উস্কানি দিচ্ছে, তাদের দায়ের কথা কেউ বলবেন কি?
এসব ঘটনা ঘটেছে এই করোনাকালে। সুরক্ষায় যেখানে অগ্রাধিকার পাবে নারী ও শিশুরা, সেখানে তাদের ফাঁসি হচ্ছে। আমরা কি দেখব সমাজে এসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য কারা দায়ী? সবকিছু তো সরকার করে দেবে না, আমাদের দায়িত্ব ও দায় আমরা তো এড়াতে পারি না।
লেখক: ড. মো হা ম্ম দ হা ন না ন
পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম বিষয়ক ফিচার