বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে গত দুই বছরে ঈদ ও বৈশাখের অর্থনীতি স্থবির ছিল। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় স্থবিরতা কাটিয়ে এবার বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখ ও ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সারাদেশের মানুষ। মৌসুমের বাণিজ্যকে ঘিরে ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আগামী ১৪ এপ্রিল বাঙালির সর্বজনীন উৎসব ‘পহেলা বৈশাখ’ বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হবে সারাদেশে। এর পর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আসছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এই দুই উৎসব ঘিরে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সুবাতাস বইছে। রোজার প্রথম দিন থেকেই ঢাকাসহ দেশের মার্কেট, শপিংমল ও ফ্যাশন হাউসগুলোয় ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে। পোশাকের পাশাপাশি দেশি শিল্প ও অন্যান্য বাণিজ্যের প্রতিটি খাতে বেচাকেনা কয়েক গুণ বেড়েছে।
করোনার থাবায় গত দুই বছর উৎসবকেন্দ্রিক বেচাবিক্রিতে ধস নেমেছিল। তবে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় সব কছু স্বাভাবিক হয়ে আসায় ঘুরে দাঁড়াচ্ছে উৎসবের অর্থনীতি। এ বছর করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় এবার অনেক আগে থেকেই ব্যবসা চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা পেছনের লোকসান থাকা সত্ত্বেও বৈশাখ ও ঈদ সামনে রেখে সবার শেষটুকু দিয়ে, ঋণ করে আবার বিনিয়োগ করেছেন। ওই সময় মার্কেট-শপিংমল খোলা থাকলেও নগরবাসী করোনাভয়ে কেনাকাটায় আগ্রহ দেখায়নি। এবার নগরবাসী মার্কেটমুখী হয়েছেন। পোশাকের পাশাপাশি বিক্রি বাড়তে শুরু করেছে- ফার্নিচার সামগ্রী, ইলেকট্রনিকস পণ্যসামগ্রী যেমন টিভি ও ফ্রিজ, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি, স্বর্ণ ও ইমিটেশন জুয়েলারির গহনা, ডায়মন্ডের রিং ও নাকফুল, জুতা-স্যান্ডেল, টুপি তসবিহসহ নানা পণ্যসামগ্রীর। এ কারণে ঈদবাণিজ্য জমে উঠেছে। উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার দেশে প্রতিবছর বাড়ছে। দুই বছরের খরা কাটিয়ে পোশাকের পাইকারি বাজারেও জোয়ার ফিরেছে বলে জানান গুলিস্তান ঢাকা ট্রেড সেন্টারের পোশাকের পাইকার ব্যবসায়ী কমফোর্ট জোনের কর্ণধার মো. দুলাল হোসেন। এবার বৈশাখ ও রোজার ঈদ ঘিরে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে জানান মালিক সমিতির সভাপতি হেলালউদ্দিন। তিনি আরো বলেন, বৈশাখকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার এবং রোজার ঈদ উপলক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা রয়েছে।
বৈশাখী অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব
বৈশাখের বাজারে করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তারা। প্রাণঘাতী করোনার প্রভাবে সবকিছুই স্থবির হয়ে যাওয়ার কারণে সারা দেশের বাজারে এসএমই খাতের ব্যবসায়ীদের পণ্য বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বৈশাখকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে সরাসরি করোনার প্রভাব পড়ে। করোনার কারণে দুই বছরে বৈশাখী ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রত্যক্ষভাবে ৩০ হাজার পরোক্ষভাবে ৬০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের গবেষণা বলছে, ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা, মুড়ি-মুড়কি বিক্রেতা আছে সারা দেশে ২৭ লাখ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ৩১ লাখ এবং মাঝারি ও পাইকারি ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৩ লাখ। এরা কেউই বৈশাখ ঘিরে ব্যবসা করতে পারেননি। কিন্তু তাদের প্রস্তুতি ছিলো, বিনিয়োগ ছিলো। তাই তরার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিপুল অঙ্কের। দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেছেন, দেশীয় পণ্যের ব্যবসায়ীদের সর্বস্ব বিনিয়োগ হয়ে থাকে পহেলা বৈশাখে। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে বর্ষবরণ উৎসব বন্ধসহ মার্কেট-দোকানপাট বন্ধ থাকায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এরফলে যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যে মাল তৈরি হয় সেটা অন্য সময় বিক্রি হয় না। এক বছর পরে আর এ পণ্যের চাহিদা থাকে না। ড. আবুল বারকাত বলেন, লকডাউনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের ২০ হাজার টাকা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ২ লাখ ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ৩ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া যেতে পারে। এদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা।
বৈশাখী উৎসব ঘিরে আর্থিক লেনদেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয়। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো তাদের এটিএম, ক্রেডিট কার্ড ও ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবস্থায় অর্থের পর্যাপ্ত জোগান রাখে। মোবাইল ব্যাংকিং ও পোস্ট অফিসের মাধ্যমেও লেনদেন বাড়ে। ২০১৮-২০১৯ দুই বছর ধরে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে সারাদেশে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে। কিন্তু ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনা ভাইরাসের কারণে সব বন্ধ হয়ে যায়। করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে পহেলা বৈশাখের পর ঈদ বাণিজ্যেও বিপর্যয়ের মুখে পড়বেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ দোকান মালিক সূত্র জানায়, বৈশাখের বাজারে দেশীয় বাঁশ, বেত, কাঠের তৈরি জিনিস, মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, প্লাস্টিকের খেলনা, বিভিন্ন ধরনের মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু বাজারেই বিক্রি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর বাইরে আরো প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার অন্য পোশাক বিক্রি হয় বৈশাখী বাজারে। এছাড়া ইলিশের বিকিকিনি হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। একইভাবে মিষ্টির দোকানগুলোয় বৈশাখে বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার মিষ্টি। সবমিলে বৈশাখে কেবল পোশাক বিক্রি হয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার।
গ্রামীণ অর্থনীতির সম্প্রসারণ
পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের উৎসব কেবল আমাদের ঐতিহ্যের ধারক নয়, এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। বৈশাখী অর্থনীতির বড় বৈশিষ্ট্য হলো গ্রামীণ অর্থনীতির সম্প্রসারণ। বৈশাখকে ঘিরে যে ধরনের পণ্যর কেনাবেচা হয় তার সবই আমাদের দেশীয় পণ্য। যার ফলে বৈশাখের উৎসব পরিসরে যত বড় হচ্ছে, আমাদের দেশের অর্থনীতিও ততটাই শক্তিশালী হচ্ছে। এসময়ে বিভিন্ন গ্রামীণ মেলায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পণ্য যত বেশি বিক্রি হয় গ্রামীণ অর্থনীতি ততই চাঙা হয়। বৈশাখে দেশীয় কুটির শিল্প, দেশীয় পোশাক, দেশীয় খাবার, হস্তশিল্পজাত গয়নাগাটি, ফুল, মুদ্রণশিল্প ইত্যাদির একটি বড় বাজার তৈরি হয়।
ষাটের দশক থেকে বৈশাখ নগরকেন্দ্রিক হতে শুরু করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশাখ শহরের প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে। বড়দের পাশাপাশি শহরের আধুনিক ছেলে-মেয়েরাও দেশি শাড়ী, সেলোয়ার-কামিজ এবং পাঞ্জাবী-লুঙ্গি, ফতুয়া পরে আনন্দে মেতে ওঠে এদিন। শুধু তাই নয়, অনেক বিদেশিদেরকে ঢাকার রাস্তায় শাড়ি-লুঙ্গি পরে হাঁটতে দেখা যায়। পোশাকের পাশাপাশি পানতা-ইলিশ, জিলাপি, হরেক রকমের ফুলের মালা, বাঁশিসহ দেশি বিভিন্ন লোকবাদ্যযন্ত্রেরও বিক্রি বেড়ে যায় বৈশাখ উপলক্ষে। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও কিছুটা গতি আসে এ দিনকে ঘিরে। কারণ এদিনে যেসব পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা অংশ গ্রামের তাঁতি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পী দ্বারা দেশি উপকরণে তৈরি। ফুল ব্যবসায়ীসহ অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে পহেলা বৈশাখের উদযাপনে। যদিও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। ধারণা করা হয়, সারা বছর যে ব্যবসা হয় তার অর্ধেকেই হয় রোজার ঈদে এবং পহেলা বৈশাখে হয় ২৫ শতাংশ। এদিনটি উদযাপনের জন্য গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরে যাচ্ছে আবার শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামে যাচ্ছে; এতে পর্যটনের সম্ভাবনা ও অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, অর্থনীতির যোগসূত্র ছাড়া কোনো উৎসবই টেকে না।