কমবে বিদেশি ঋণ

লোগো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)

রাজস্ব

কমবে বিদেশি ঋণ

# এডিপির ৭০ শতাংশ হবে অভ্যন্তরীণ অর্থায়নে # জিডিপির ১.৬০ শতাংশে নামবে বিদেশি সহায়তা

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ১৮ জানুয়ারি, ২০১৯

বাংলাদেশে বিদেশি সহায়তা বাবদ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসেছিল ৭১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ইতিহাসের সর্বোচ্চ বিদেশি সহায়তা ছাড়ের পর এবার তা ৬০০ কোটি ডলারে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। আগামী দুই অর্থবছরেও বিদেশি সহায়তা ৬০০ কোটি ডলারের ঘরেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায় সরকার।

বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বিদেশি সহায়তা স্থির থাকলেও অর্থনীতির পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার। ফলে জিডিপির তুলনায় বিদেশি সহায়তার পরিমাণ কমছে আনুপাতিক হারে। ইআরডির নিয়মিত প্রকাশনা ‘ফ্লো অব এক্সটারনাল রিসোর্সেস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকাশনা ও আগামী কয়েক বছরের বিদেশি সহায়তার প্রাক্কলন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে দ্রুত। অর্থনীতির পরিধির সঙ্গে উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিধিও বাড়ছে। হাতে নেওয়া হয়েছে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কক্সবাজার রেল সংযোগের মতো বিশাল প্রকল্প। চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিদেশি সহায়তা না বাড়ায় নিজস্ব অর্থায়নে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো খাতে প্রত্যাশিত হারে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে আগামীতে অভ্যন্তরীণ তহবিলে গুরুত্ব দিতে চায় সরকার।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০-৯১ অর্থবছর বাংলাদেশে বিদেশি সহায়তা আসে ১৭৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার। ওই বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ছিল ৩ হাজার ১৯৬ কোটি ডলার। এ হিসাবে জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ বিদেশি সহায়তা আসে ওই বছর। সময়ের ব্যবধানে বিদেশি সহায়তা ৭০০ কোটি ডলার ছাড়ালেও জিডিপির তুলনায় গত বছর অর্থ ছাড় নেমেছে ২ শতাংশে। চলতি অর্থবছরের মধ্যে এর হার ১ দশমিক ৯৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। আগামী অর্থবছর জিডিপির ১ দশমিক ৮০ শতাংশ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ দশমিক ৬০ শতাংশ বিদেশি সহায়তা সংগ্রহ করার লক্ষ্য রয়েছে।

সরকারের উন্নয়ন ব্যয়েও কমে আসছে বিদেশি সহায়তার হার। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে ৬ হাজার ১২৬ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বিদেশি সহায়তা ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এডিপি বরাদ্দের ৬০ শতাংশ অর্থ ওই সময়ে বিদেশি উৎস থেকে এসেছিল। চলতি অর্থবছর ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার এডিপিতে বিদেশি সহায়তা ধরা হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। মোট এডিপির ৩৩ দশমিক ১৭ শতাংশ ধরা হয়েছে বিদেশি সহায়তা। আগামী অর্থবছর এডিপির সাড়ে ৩১ শতাংশে নেমে আসবে প্রকল্প সহায়তা। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যে তা ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে বাংলাদেশে বিদেশি অনুদানের চাহিদা কমে আসছে। এখন খাদ্য ও পোশাকের চাহিদা মেটাতে আর ঋণ করতে হয় না। তবে অবকাঠামো খাতের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। তুলনামূলক কম সুদে এসব ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এ অবস্থায় নতুন প্রযুক্তি হস্তান্তরের সম্ভাবনা রয়েছে এমন খাতে বিদেশি ঋণ অনুসন্ধানের পক্ষপাতী এ অর্থনীতিবিদ।

ইআরডির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত চার দশকের বেশি সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি সহায়তার ধরনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার প্রথম কয়েক বছর ঋণ ও অনুদান হিসেবে খাদ্য সহায়তা নিতে হতো বাংলাদেশকে। দেশে উৎপাদন ব্যবস্থা চালুর আগ পর্যন্ত অনেক ধরনের পণ্যও আনতে হতো বিদেশ থেকে। এ জন্য ঋণ ও অনুদান নিতে হতো। শুরুতে প্রকল্প সহায়তার পরিমাণ কম ছিল। এখন বিদেশি সহায়তার প্রায় শতভাগই আসে ঋণ হিসেবে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যানুযায়ী, ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে প্রাপ্ত বিদেশি সহায়তার ৮৬ শতাংশ অর্থ এসেছিল দ্বিপক্ষীয়ভাবে। এসব সহায়তার সিংহভাগই ছিল অনুদান। ঋণ হিসেবে আসা দ্বিপক্ষীয় সহায়তার সুদের হার ছিল বেশি। পরিশোধের সময়ও ছিল কম। রাষ্ট্রখাতের কল-কারখানা সচলরাখা ও বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো তৈরির জন্য বাংলাদেশের হাতে তখন বিকল্প ছিল না। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে বৈদেশিক অর্থ সহায়তার মাত্র ১৪ শতাংশ পাওয়া গিয়েছিল বহুপক্ষীয় সংস্থা থেকে।

ইআরডি সূত্র জানায়, ১৯৭২-৭৩ সময়ে বৈদেশিক সহায়তার ৩৮ শতাংশ এসেছিল খাদ্য বাবদ, প্রায় ৫২ শতাংশ উপকরণ ও মাত্র ১০ শতাংশ উন্নয়ন প্রকল্পে। সহায়তার ৮৯ শতাংশ ছিল অনুদান, ১১ শতাংশ ঋণ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট বৈদেশিক সহায়তার ৬৪ শতাংশ ঋণ, অনুদান ৩৫ শতাংশের কিছু বেশি এসেছে। প্রকল্প সহায়তা বাবদ এসেছে ৯৯ শতাংশ অর্থ, খাদ্য সহায়তা ১ শতাংশের মতো। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছাড় হওয়া বিদেশি সহায়তার ৯৯ দশমিক ২০ শতাংশই এসেছে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে। সাড়ে ১২ শতাংশ অনুদানের বিপরীতে ঋণ হিসেবে এসেছে সাড়ে ৮৭ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, অবকাঠামোর স্বল্পতা থাকায় বাংলাদেশে এ খাতে অর্থ ব্যয় করতে হবে। আর বিদেশি সহায়তার বড় অংশই আসছে অবকাঠামো খাতে। রফতানি আয় ও মোট জাতীয় আয়ের (জিএনআই) তুলনায় বাংলাদেশে আরো বিদেশি সহায়তা আসার সুযোগ আছে। তবে অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমেছে। কঠিন শর্তে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি প্রকল্পের লাভ-ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে ইআরডি জানায়, জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি যেকোনো দেশের জন্য নিরাপদ। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির সাড়ে ১৫ শতাংশের নিচে। পণ্য ও সেবা খাতে রফতানি আয়ের দেড়গুণ পর্যন্ত ঋণ নেওয়াকে নিরাপদ মনে করে বিশ্বব্যাংক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঋণ রয়েছে রফতানির ৭৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। এক বছর আগে বাংলাদেশের মোট ঋণের স্থিতি ছিল জিডিপির ৭১ দশমিক ২০ শতাংশ।

এক বছরে মোট রফতানি আয়ের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি ঋণ পরিশোধকে নিরাপদ মনে করে আইএমএফ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল রফতানির মাত্র ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। রাজস্ব আয়ের বিবেচনায়ও ঋণ পরিশোধের হার নিরাপদ রয়েছে বলে মনে করে ইআরডি।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, খাদ্য সহায়তা কমে আসা অর্থনীতির বড় একটি ইতিবাচক দিক। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার খুব কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের রফতানি আয় অনেক বেড়েছে। এ অবস্থায় পণ্য সহায়তার প্রয়োজন থাকার কথা নয়। তবে সহজ শর্তে ঋণ যতদিন পাওয়া যায় নিতে হবে। দেশের অর্থনীতি আরো উন্নত হয়ে এ সহায়তা নিতে হবে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads