বহুল প্রচলিত কথা বাঙালি হুজুগে জাতি। সময়ের সঙ্গে আমরা পরিবর্তন হয়েছি, হচ্ছি কিন্তু চরিত্র পুরোপুরি পরিবর্তন করতে পারিনি এখনো। আমাদের মস্তিষ্ককে এখনো অলস রেখেই আমরা তা ব্যবহার করি। অথচ আমরা যদি মস্তিষ্কটা ব্যবহার করে চিন্তা বা সমালোচনা করি, তবে অহেতুক অনেক কিছু ভাইরাল হয় না। পরিকল্পনামন্ত্রী সেদিন গবেষণার গুরুত্ব বোঝাতে মজার ছলে বলেছেন, ‘কচুরিপানা কি কোনোভাবে খাওয়া যায় না?’ পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন ‘গরু খায়’, তখন মন্ত্রী হাসতে হাসতেই বললেন, ‘গরু যদি খেতে পারে, আমরা কেন পারব না?’ মূলত কচুরিপানা কোনোভাবে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা যাবে কিনা এই ব্যাপারে গবেষণা করে যেতে হবে। গবেষণার ওপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করতেই মজা করে মন্ত্রী কথাটা বলেছিলেন। অথচ সংবাদমাধ্যমগুলো অধিকমাত্রায় জনগণকে আকর্ষণ করার জন্য হেডলাইন করলেন ‘মন্ত্রী কচুরিপানা খেতে বললেন’।
একাত্তর টিভির এক সচিত্র প্রতিবেদন থেকে জেনেছি, বরিশালের আগৈলঝাড়ায় এক নারী কচুরিপানা ব্যবহার করে পেপার, রঙিন পেপার, বিভিন্ন ধরনের কার্ড ইত্যাদি তৈরি করছেন খুব সহজেই। এটা করে তিনি এখন স্বাবলম্বী। তার দেখাদেখি অনেক মহিলাও এগিয়ে এসেছেন। ফলে মানুষের কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছে উক্ত এলাকায়। কচুরিপানার ফুলের পাকোড়া খেয়েছেন বলে এক লেখক ও সাংবাদিক তার লেখায় জানিয়েছেন। কম্বোডিয়ায় শোলমাছের সাথে কচুরিপানা খাওয়া হয় বলে শুনেছি। এসব ছাড়াও কচুরিপানার বহু ব্যবহার কমবেশি সবাই জানেন। গবেষণার মাধ্যমে যদি এটা খাওয়ার উপযুক্ত করা যায়, তবে মন্দ কী? বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জাতীয় সংসদে যথার্থই বলেছেন, ‘প্রতিদিন নতুন নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন আসছে। আগে মাশরুম দেখলে বলা হতো ব্যাঙের ছাতা, নিষিদ্ধ খাবার। এখন তা খাওয়া হচ্ছে। হয়তো এমন দিন আসবে, কচুরিপানা থেকেও খাবার আবিষ্কৃত হবে।’
বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগানে নতুন নতুন গবেষণার প্রয়োজন আছে। প্রকৃতিতে কোনো কিছুই সৃষ্টিকর্তা এমনি এমনি দেননি। বিশ্বে এখন খাদ্য সংকট প্রকটই বলা যায়। চীনাদের খাদ্যতালিকায় দেখলাম জীবজন্তুও কাছে। বাংলাদেশেও কচ্ছপ আর কুচিয়া খাওয়া হয় বলে কমবেশি সবাই জানি। অতএব পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করার কিছু নেই। একে যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করাই শ্রেয়। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিকল্প খাদ্যের খোঁজে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা আছে।
সেই গবেষণা সফল হোক বা না হোক, সফল হতে হবে আমাদের কমনসেন্সের। জাতি হিসেবে সচেতন হওয়া খুব জরুরি। আমাদের চিন্তার প্রসারতা বাড়াতে হবে। বিশ্লেষণ না করে কোনো কিছু ভাইরাল করে দেওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। হুজুগে জাতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সাধারণ মানুষদের এসব ব্যাপারে বিচার-বিবেচনাবোধ কম হলেও, শিক্ষিতদের চিন্তাভাবনার চর্চা করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিক্ষিতদের মধ্যে এসব বিবেচনাবোধের লক্ষণও আজকাল লোপ পাচ্ছে। সংসদে দাঁড়িয়েও স্বল্পবুদ্ধির পরিচয় দিতে দেখেছি (পরিকল্পনামন্ত্রীর জন্য সংসদে কচুরিপানা নিয়ে গিয়েছিলেন)। বর্তমান সময়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এসব বোধের চর্চা করে না। যা পায় তা-ই নিয়ে মেতে ওঠে, ভাইরাল করে, ট্রোল করে। এভাবে চলতে থাকলে, না জানি কবে আরেকটা বিশেষণের অধিকারী হয়ে যাই— বাঙালি ‘ভাইরাল জাতি’।
সংবাদমাধ্যমগুলোকেও হেডলাইন তৈরিতে আরো সচেতন হওয়া জরুরি। ইদানীং এমনভাবে হেডলাইন প্রকাশ করে, যেখানে অনেক ক্ষেত্রে মূল কথাই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। মানুষের মনস্তত্ত্বকে উসকে দেয়, এমন শিরোনাম না হওয়াই উচিত। কারণ শিরোনাম দেখেই লোকজন প্রতিক্রিয়া শুরু করে দেয়; পুরো নিউজ কমই পড়ে। জনগণকে আকর্ষণ করার চেয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর নৈতিকতার চর্চা বেশি প্রয়োজন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। আমাদের শুভবুদ্ধি ও সৎ চিন্তাভাবনার উদয় হোক।
অনিল মো. মোমিন
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া