মুক্তমত

ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে আইনের প্রয়োগ জরুরি

  • প্রকাশিত ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

অলিউর রহমান ফিরোজ

 

ওধুষশিল্পে ভয়াবহ অরাজকতা বিরাজ করছে। মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ ওষুধের ভেজাল দেখলে গা শিউরে ওঠে। ভেজালকারীরা এতটাই বেপরোয়া যে, মানুষের জীবন সংহার করার মতো ওষুধ দেশের আনাচে-কানাচে অনুমোদনবিহীন ফার্মেসিগুলোতে সরবরাহ করে চলেছে।

এসব ভেজাল ওষুধে বেশি ক্ষতির শিকার হয় গ্রামের সহজ-সরল নিরীহ সাধারণ মানুষ। আর ভেজালকারী এবং লাইসেন্সবিহীন ওষুধের বড় চালানগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রির জন্য তারা মূলত টার্গেট করে থাকে। তবে শহরের অনেক দোকানেও মানহীন এবং ভেজাল ওষুধ রাখার খবর পাওয়া যায়। সাধারণ একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভেজালকারীরা এসএমসির ওরস্যালাইন নকল এবং মানহীন অবস্থায় দেশের মুদি দোকানগুলোয় পর্যন্ত সয়লাব করে ফেলেছে। এগুলো বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে তৈরি করে অবিকল এসএমসির প্যাকেটের মতো মোড়কে তারা বাজারজাত করছে। একটা খাওয়ার স্যালাইন পাতলা পায়খানা এবং শরীরের পানিশূন্যতার জন্য অতি আবশ্যক। সেখানে যদি আটা ও লবণ মিশ্রিত পানি সারা দিন ধরে খাওয়ানো হয় তাতে রোগীর কী হবে! দেশে সবচেয়ে বেশি ভেজালের শিকার হয় নামিদামি কোম্পানির গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। কারণ বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এ ওষুধগুলোর। ভেজালকারীরা বেশিরভাগ ওষুধই মিটফোর্ড পাইকারি বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারা দেশে বাজারজাত করে থাকে।

সরকার ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ও ভেজাল ওষুধ তৈরি, মজুত, বিক্রি এবং আমদানি-রপ্তানিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০টি দেশে এখন ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। অ্যালোপ্যাথিক আইটেমের ২০৮টি ওষুধ কোম্পানি তিন হাজার ৫৮৮ জেনেরিকের প্রায় ৩০ হাজার ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ওষুধ বাজারজাত করছে। আবার খোলা বাজারে কোটি কোটি টাকার নকল এবং ভেজাল ওষুধও রয়েছে। এর প্রমাণ বিভিন্ন সময়ে মিটফোর্ড থেকে ধরা পড়া কোটি কোটি টাকার ওষুধের চালান।

বিদেশে ওষুধ রপ্তানি করে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। কিন্তু দেশে এতদিন শুধু একটা নীতিমালা দিয়ে ওষুধ বাণিজ্য চলত। তাতে ছিল নানারকমের জটিলতা। এক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ)-এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্য ও ওষুধ নকল করে বিক্রি করলে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। নকল ওষুধ তৈরির সঙ্গে যুক্ত অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত এ আইন কার্যকর করতে হবে।

ওষুধ জালিয়াতকারীরা মফস্বল জেলাগুলোতে কারখানা তৈরি করে সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো মানুষের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভেজাল ওষুধ তৈরি করছে। তাতে কিছু লোভী ফার্মেসির মালিকরা বড় ধরনের কমিশন পেলেও ক্রেতা ঠকছিলেন জবরদস্তিমূলকভাবে। বিশেষ করে শিশুদের ওষুধের আধিক্য বেশি থাকায় ওই কোম্পানিগুলো শিশুদের ওধুষেই ভেজাল বেশি করছে। ভেজাল ওষুধে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক শিশুর জীবনও বিপন্ন হতে বসেছে। 

দেশে বক্ষব্যাধির ওষুধের মধ্যে সেরিটাইড নামে একটা ওষুধ আমেরিকা থেকে আনা হয়ে থাকে, যা দেশের বাজারে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। বিশেষত অ্যাজমায় ওষুধটি অত্যাবশ্যকীয়। এখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা যখন সেরিটাইড ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন তখন রোগীকে সে ওষুধ ছাড়া অন্যটি ব্যবহার করতে অনীহা দেখা দেয়। তবে হ্যাঁ, কিছু ওষুধ আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। তা পাশের দেশ ভারত থেকে আনা হয়ে থাকে। মিটফোর্ডের পাইকারি বাজারের মাধ্যমে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের নীতিমালায় বাইরের ওষুধ বৈধভাবে আনাটা অনেক জটিলতার বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে আনার কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। তখনই ওষুধগুলো অবৈধভাবে দেশের বাজারে ঢুকে পড়ে। আর এতে সরকারও রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। পাশের দেশ ভারত থেকে গ্ল্যাস্কোর তৈরি ইনু আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে চাহিদা রয়েছ। কিন্তু তা আসে অবৈধভাবে। ওষুধের সবচেয়ে বড় বাজার মিটফোর্ডেও মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ওষুধ জব্দ করে। তবে জনবল সংকটের কারণে ওষুধ অধিদপ্তরের পক্ষে সারা দেশে অভিযান চালানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই দেশের মানুষ ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্যে নাকাল হচ্ছে।

ওষুধ হলো রোগব্যাধিতে জীবন রক্ষার অন্যতম উপাদান। আর তা নিয়ে যারা খেলা করেন, বিত্তবৈভবের মালিক হন, তাদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া চলবে না। এসব জঘন্য প্রতারককে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। জেনে অবাক হতে হয়, এমন ওষুধ রয়েছে হারবালের যার মূল্য তালিকা গায়ে লেখা সাড়ে ৩০০ টাকা। তাতে বিক্রেতার কমিশনই ২৫০ টাকা। এসব বিক্রেতার কোনো লাইসেন্স নেই। মফস্বলে কখনো অভিযান চালানো হলেই তারা ফার্মেসি বন্ধ করে কেটে পড়ে। মাঝেমধ্যে দু-একজন ধরা পড়েন।

ওষুধ নীতিমালায় প্রয়োজনীয় ওষুধ আমদানির বিষয়টি যদি সহজ করা হয় তাহলে সরকার রাজস্ব পাবে। অনেক সময় দেখা যায়, দেশের কোম্পানির ওষুধই চাহিদা মাফিক পাওয়া যায় না। ফার্মেসির মালিকদেরই তা বাড়তি দামে কিনতে হয়। আর বিক্রি করতে হয় নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি। সেখানে চাহিদাপূর্ণ বিদেশি ওষুধের জন্য নিয়ম-নীতির মাধমে আমদানির সহজ পথ তৈরি না করলে সেই ওষুধই দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্যে মানুষকে কিনতে হবে। তাতে দেশের রোগীরা সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে পড়বে। নতুন খসড়ায় কোনো ডাক্তার আমদানি করা ওষুধের নাম লিখতে পারবেন না বলে উল্লেখ আছে। এখন অতি জরুরি ওষুধটি কীভাবে সংগ্রহ করা হবে। তবে দেশে যে ওষুধ পাওয়া যায়, সেই ওষুধ ব্যবহারেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের আগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশে যে ওষুধ পাওয়া যাবে না তা উন্মুক্ত করে দিতে হবে।

ওষুধশিল্পের অগ্রগতি সাধনে বিশ্বের অনেক দেশের স্বীকৃতি সনদ মিলেছে বাংলাদেশের। বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে হলে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে আশার কথা, এবার ওষুধ আইনে সরকারের প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি বছর একবার ওষুধের দাম হালনাগাদ করতে পারবে। আর বিষয়টি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে বিধায় ক্রেতারা দামের ব্যাপারে ইচ্ছা করলেই ওয়াকিবহাল হতে পারবে। দেশে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের সংখ্যা হবে ২৮৫টি। ইউনানির ওষুধ ২২৩ এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধ থাকবে ৩৭০টি। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ থাকছে ৩৯টি। তবে আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক এবং ইউনানির ওষুধকেও আইনের আওতায় আনা জরুরি।

 

লেখক :  নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads